চা-পাতা ৯৮
সম্পাদকীয়
হাসপাতালে এসে দেখলাম জন্ম ও মৃত্যুর সার্টিফিকেট দুটোই একই কক্ষে একই ব্যক্তি একই আইনের আওতায় প্রদান করেন । ফাইলদুটো এত পাশাপাশি রাখেন যেন মাঝখানের এত বছরের জীবন কিচ্ছু নয় । জাস্ট তারিখদুটো বসিয়ে দিলেই সব মিটে যায় । জন্মতারিখ আমাদের জানাই থাকে, মৃত্যুর তারিখটা কল্পনা করে আমরা একটি ঝুলন্ত সেতু তৈরি করে দুলতে থাকি । দুলতে দুলতে দড়ি নরম হয়ে আসে, একসময় তা ছিঁড়ে যায় । কল্পিত তারিখটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে ।
কবিতা
তুষারকান্তি রায়
মায়া
চাঁদ সহ ভেসে যাচ্ছে জল , আর
সাঁতারে ডুবের ছন্দ , জলের আওয়াজ ...
খলবলে ঢেউ ,
অতল ছুঁয়ে থাকা কথার সম্বিত !
ভেসে যাচ্ছে ত্রিবেণীর জামতলা ,
খুঁজে না পাওয়া গানের গন্ধ , শ্যামচাঁদ লেন এর সুধাময় আলো নিয়ে
নীল ও নিলাম !
তামার মুদ্রার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্নের
এখন মুঠো মুঠো ছুটি ...
দ্যাখো, আমাদের খড়কুটো
চাঁদ ওঠা আলো -
এসো! পাশে বোসো , শ্বাস নাও
নবমীর জানলায় প্রকাশ্য পয়গম নিয়ে
কথা হোক ! খোশহাল খবরের কথা শোনো
আয়নায় মুখ রাখো,
চোখ থেকে মুছে ফেলো বিয়োগের দাগ ,
লেখো শঙ্খবেলা ,
কবিতায় জলের ঝিনুক
দেবব্রত দাস
পাহাড়ের কান্না
আজ এই রাতে
তোমার মুখটা দেখলাম
ঝোড়ো হাওয়ায় ডালপালাহীন বৃক্ষের মতো
তুমুল একা।
আরও দেখলাম টবে ফুল ফোটার প্রস্তুতি নিয়ে
যে গাছটা বড় হচ্ছে নিভৃতে
তারই আগাম কয়েকটা কুঁড়ি
তোমার চোখের ভেতর গোপনে থাকা
ক্যামেলিয়ায় ফুটে উঠছে।
আমি দু'হাতে তোমার চিবুক ধরে
জোছনার নীরবতা নিয়ে
ঢুকে গেলাম কুঁড়ি থেকে ফুলের বেরিয়ে আসা
দেখবো বলে।
অথচ আকাশ ধুসর করে হাজারো পাখির
উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে
ভুলে গেছি আমাদের চূড়ান্ত
পাহাড়ের কান্না...
বিকাশ দাস ( বিল্টু )
জমি
বাবা পড়তে জানতেন না
বিঘার পর বিঘা জমি অনায়াসে চাষ
করতে জানতেন। কোন জমিতে কি চাষ
কোন ঋতুতে কি ফসল প্রমুখ...
একদিন বাবাকে আবিষ্কার করি
পলিমাটির বুক নিয়ে কাঁদছেন তিনি
লুকিয়ে লুকিয়ে
জিজ্ঞেস করতেই উত্তর এলো
চাষ ছাড়া আমি বাঁচবো কিভাবে
আমাদের এক চিলতেও জমি নেই আর
বন্ধকি হয়ে গেছে সব
মনে আছে
সেদিন সারারাত লুকিয়ে লুকিয়ে
কেঁদেছিলেন মা
উজ্জ্বল বর্মন
কতক কথা
এখন কবিতা আর আসেনা,যা আসে বা যা দেখি মায়ের চোখে জ্বলন্ত আগুন;
দেখি চোখে লুকিয়ে রাখা ভয়ংকর মেঘ।
বাবার চোখে কখনো মেঘ দেখিনি হয়তো সন্তর্পণে বদ্ধ করে রেখেছে,
প্রচন্ড মেজাজ দেখেছি,অজানতে বটপাকুড়ি হয়ে ছায়া দিতে দেখেছি,
রক্ত ঝরা দেখেছি সমস্ত শরীর বেয়ে মিশে যাচ্ছে মাটিতে।
এমনি অনেক কবিতা দেখছি রোজ এই শহরে।
যারা স্ব-ইচ্ছায় ইতিহাস হতে আসেনি,তারাও ক্রমশ ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছাপ ফেলে চলেছে।
কলমটিকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে শব্দ বুনছি,
পেটে খোরাক নেই অথচ সংগ্রাম চলছে মৃত্যুর।
লিখে চলেছে সুখের রহস্যময় সন্ধান!
কলমটি অথচ কত নির্বোধ ! সে জানেই না-
অসুখ তাড়া করলে আর সুখে থাকা যায়না।
ইনাশ্রী মন্ডল
পুনর্জন্ম
আমি প্রতিবার বেঁচে ফিরে আসি ফিনিক্স পাখির মতো
মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র কাটায় পথের বাধা যত,
যতই লাগুক আগুন ছোঁয়াচ পোড়েনা অধরা মন,
খাদে যার বাসা ,পড়ার ভয় পায় না তো সেই জন ৷
ছিঁঁড়ে যাক যত হৃদয় তন্ত্রী বয় না রক্তরেখা,
রক্তের রঙে চিরায়ত হয় অতুলনীয় সে শেখা ৷
স্বাগতা ঘোষ
শব্দে রাখা সম্পর্ক ৯
শ্মশান পথে যেতে পলকা ব্রিজের ঝুঁকি নিয়ে আমার বাড়ি আসিস। এখানেও এক বুক শ্মশান। চিনেছিস ঠিক। শ্মশান পুড়ে গিয়ে যে প্রান্তর প'ড়ে থাকে তার ধানেও মড়াপোড়া ঘ্রাণ মিশে থাকে। সে কথা বিক্রমাদিত্য জেনেছিলেন নিশ্চিত।
আকাঙ্ক্ষার যে তীব্রতায় ফিরে ফিরে আসিস, সে সম-তীব্রতায় ক্ষতবিক্ষত হ'য়ে যাস গ্রন্থিচ্ছেদের আমোঘ টানে। এসব আসা-যাওয়ার টানাপোড়েনে, অলীকে সত্যি খুঁজে নিই তোর ভাসা ভাসা দু'চোখের অতল নিশ্চুপে। শীতকাঁথায় পাশ ফিরে শুই। কবি বলেন, পাশ ফিরলে সত্যির ছবি পাল্টে যায়।
অর্ধনগ্ন নারীর স্নান শরীর বেয়ে ধুয়ে যাচ্ছে ঘন নীল। এ ছবি দেখেছি নবীন শিল্পীর তুলিতে। কঠিন শীত রাতে নিজের দেহ থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি না ধোঁয়াটে মৃত্যুর চাপ চাপ কালো দাগ।
ভীষণ মায়াহীনতায় ভেঙে যেতে যেতে প'ড়ে ফেলছি অনুবাদের বোদলেয়র। আরও অন্ধকার হ'য়ে উঠছে শহরের রঙ। বড় হ'চ্ছে মৃত্যু কায়া। বাবার বুকের গাঢ়, কিংবা মায়ের আঁচলের কালো ব্লক প্রিন্ট ভেবে, এক ফালি চাঁদ খুঁজতে চাইছি রোদ না পাওয়া ভালোবাসা রাতে। কিনে আনছি সাপের যন্ত্রণা।
আধকাঁচা রুটির পেটে পুরে নিচ্ছি পোড়া মাংস। চুল পোড়া গন্ধে বমি করতে চাইছি কয়েক জন্মের প্রতিশোধ ও প্রত্যাশা। আঙুলের ফাঁকে রাখা মৃত্যুতে গিলে ফেলছি আরও আরও মৃত্যু তরল।
এসব ভুলে যেতে রাত তিনটের ছাদে দাঁড়াই। মুখে পুরে দিই এক টুকরো ডায়াবেটিক ক্রিম ক্র্যাকার। মুখের ভিতর ছেয়ে যেতে থাকে লেইলেই মৃত্যুর বিস্বাদ বিষাদ।
একটু চা খেলে হ'তো। দু'এক পেয়ালা ঘুম প্রার্থনা করছি খুব রাত আকাশের কালপুরুষের কাছে।।
প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবি - দেবমিত্রা চৌধুরী
পাশাপাশি রাখা দুটো ফাইলের মাঝের ওই দূরত্বটুকুই কবিতা। আর সার্টিফিকেট প্রদানকারী ব্যাক্তিটি যমরাজের আত্মীয়। তোমার সম্পাদকীয়ই কবিতা হয়ে ওঠে।
উত্তরমুছুন