চা- পাতা ৯৩
সম্পাদকীয়
আমরা মেলায় আসি, জীবনের বাধা বিপত্তি সব পেরিয়ে আসি । সুখী মানুষ সুখ ছড়াতে আসে দুখীরা দুঃখ ছড়াতে আসে। রঙিন মুখ আর রঙিন বেলুন পাশাপাশি ওড়ে, রঙে রঙে হুড়োহুড়ি লেগে যায় । সস্তার শার্ট দামি জামার গন্ধ ছুঁয়ে ফেলে । ফাটা পায়ের ধুলো গিয়ে লাগে রঙিন পা'য় ।
এই মেলা-মেলা আচরণগুলো রোজ করিনা কেন । কেন এত দূরে দূরে থাকি । কেন হিংসুটে, ফাঁকা হয়ে থাকি ।
বুদ্ধপ্রিয় সরকার
অফবিট
মারুফ আহমেদ নয়ন
কৃতজ্ঞতা স্বরুপ, আমার এ জীবনঃ
তোমার সখীদের সাথে চড়ুইভাতি উৎসব শেষে ফিরে এসো। আমি গ্রহের একটি কক্ষপথ থেকে বিদায় জানাচ্ছি। আমার বাক-বাকুম পায়রা, তোমাকে স-যত্নে রাখবো, যেমন রেখেছি তোমার তসবির সিনার ভেতরে। এ হৃদয় কতোটা মশগুল, যেমন ভ্রমরেরা হয় ফুলের প্রতি। চুম্বন করো, আমাকে। এই প্রস্তর হৃদয় লক্ষ বছর ধরে তোমাকে রেখেছে জীবন্ত, বিষন্ন গোলাপের ফসিল।
পাপে-তাপে ধরে রেখেছে লুপ্তপ্রায় প্রেম, ধূলির প্রাসাদ, সিংহাসন। অথচ তা কোথায় চোখের পলকে মিলিয়ে গেলো। তোমাকে পাবো এমন অন্ধ বিশ্বাসে, পূর্বজন্ম থেকে গাছের ছাল-বাকলে ও পশু চামড়ায় অঙ্কিত করেছি তোমাকে। অন্ধ এক ভাস্করের সাথে বসে প্রস্তুত করেছি, দেবীমূর্তি। আমার কল্পনার ভেতরে বুঝি তুমি।
আমার পরিচয় সম্বন্ধে বলি, দূর সমুদ্রে লুট হয়ে যাওয়া জাহাজের নাবিক, জলদস্যুর ছোরার আঘাতে লুটিয়ে পড়েছি, তারপর ভেসে ভেসে তোমার নিকটে এসেছি। আমাকে তুলে নাও তুমি, যেভাবে লোকে তুলে নেয় থলে ভর্তি মোহরের দুঃস্বপ্ন। আমার সেবা-শুশ্রূষা করো, যেন লাভ করি আরোগ্য। তোমাকে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ, আমার এ জীবন দিয়ে দেবো।
১.
সকালের কুয়াশা ভেদ করে রক্তিম সূর্যটা প্রতিদিনই একটু একটু করে মাথার ওপরে উঠে যায়। তখন মধ্যদুপুর। তারপরই একটু একটু করে সে পশ্চিমে ঢলে পড়ে। যত বেশি পশ্চিমে ঢলে পড়তে থাকে তত বেশি বেজে ওঠে বিদায়ের বিষাদ বাজনা। তখন সে একবুক হতাশ্বাস নিয়ে ফেলে আসা দীর্ঘ পথের দিকে চেয়ে হিসেব মেলাতে চায় কতটা পথ সে পাড়ি দিয়েছে। ফেলে আসা পথের সুদীর্ঘ ঘটনাপরম্পরা তাকে এক ভিন্ন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়। এ এক এমন সত্য, যে সত্য সে, চলতে চলতে, হাঁটতে হাঁটতে আদৌ অনুভব করতে পারেনি। বর্তমান তাকে যে অনুভূতি, উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তাতে উপলব্ধি হয় প্রকট, প্রত্যক্ষ, সন্নিহিত বাস্তবতা যেন এতদিন তাকে প্রতারণা করে এসেছে। আসলে ‘হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম’, হিরণ্ময় পাত্র দিয়ে সত্যের মুখ ঢাকা থাকে। প্রত্যক্ষ, সন্নিহিত, প্রকট বাস্তব হিরণ্ময় পাত্রের মতো, চোখ ধাঁধানো আলোয় গূঢ় সত্যের মুখ ঢাকা থাকে। তখন প্রকৃত সত্যটা সঠিক চেহারায় দৃষ্টিগোচর করা সম্ভব হয় না। প্রত্যক্ষ দর্শনের আবেগ দৃষ্টিকে বিপথে পরিচালিত করে। সৃষ্টি হয় ভয়ানক বিভ্রম। জীবন যত গড়িয়ে চলে, সন্নিহিত বাস্তব যত দূরে সরে যেতে থাকে, ততই ক্রমশ ফোকাস দূরত্ব পেতে থাকে পূর্ববর্তী বাস্তব, ফেলে আসা অতীত। ফলে, নিজের ফেলে আসা সময়কে ফিরে দেখতে গিয়ে সত্যের প্রকৃত চেহারাটা অনেকটাই ধরা পড়ে। সত্যিটা দৃষ্টিগোচর না হলে তার মূল্যায়নও সম্ভব হয় না। সেকারণেই অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনীয় ফোকাস দূরত্ব, সময়ের ব্যবধান। গড় মানুষের আয়ুর অর্ধেকের বেশি অতিক্রান্ত হলে, পুবের আকাশের ফেলে আসা দীর্ঘপথ অনেকটাই স্পষ্ট চেহারায় ধরা দেয়। ফেলে আসা সময়ের দাগগুলো চিনে নিতে তখন অনেক সুবিধে হয়। সেকারণেই কি অতীতচারণা? সময়ের চিহ্নগুলো চিনে নেবার প্রয়াস? ব্যক্তির নিজের ক্ষেত্রে এই সত্যোপলব্ধির সুফল লাভ সম্ভব হয় না প্রায়ই। কারণ, তার সক্রিয়তার ঘড়ি অনেকদূর এগিয়ে গেছে ততদিনে! তার পক্ষে আর নতুন করে পথ চেনার কোনো প্রয়োজনীয়তা হয়ত থাকে না। কিন্তু প্রাণের লক্ষণই যে, তাতে দুটি শর্তহীন পরাবর্ত ক্রিয়াশীল থাকে। একদিকে আত্মরক্ষা আর অন্যদিকে প্রজাতিরক্ষার শর্তহীন পরাবর্ত। সেকারণেই আমাদের ইতিহাস চর্চা এত জরুরি। তবে, সেটা সমষ্টিজীবনের ক্ষেত্রে। কিন্তু, ব্যক্তিও তো ইতিহাসের অংশ। ব্যক্তির অভিজ্ঞতাও সমাজকে, তার মানুষকে পুষ্ট করতে পারে। নতুন জ্ঞানের আলোকে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রজন্মবাহিত অনেক অর্জন মানুষের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, গেছে চিরকাল। পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে প্রজাতিরক্ষার শর্তহীন পরাবর্ত। মনে পড়ে যায় সেই গল্পটা, যেখানে এক বৃদ্ধ তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাহাড় খুঁড়ে চলেছিল। তাকে একজন জিগ্যেস করেছিলো, কেন সে একাজ করছে? একটা পাহাড় কাটতে কাটতে তো বৃদ্ধের আয়ুই ফুরিয়ে যাবে। বৃদ্ধের জবাব ছিল, কথাটা ঠিকই. কিন্তু এই পাহাড় সে যেমন কেটে চলেছে, তেমনই কেটে চলবে তার ছেলে, এবং তার ছেলে, প্রয়োজন হলে তার ছেলেও! ফলে, একদিন পাহাড় নিশ্চিহ্ন হবে এবং এই ঘরে আলো ফেলবে ভোরের প্রথম সূর্য। প্রজন্মের স্বার্থে এটাই মানুষের শর্তহীন পরাবর্ত। রিলে রেসের মতো, এই সভ্যতা। একটি কাজের ভুলত্রুটি, অসম্পূর্ণতার খতিয়ান লিপিবদ্ধ করে রাখা। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তা থেকে অভিজ্ঞতা, শিক্ষা নিয়ে নিজের পথ স্থির করতে পারে। মানব সভ্যতার সম্পূর্ণ ইতিহাসই এই পরম্পরায় বিধৃত। ফলে, নিজের অভিজ্ঞতা অন্যের কাজে লাগতে পারে এই ক্ষীণ আশা নিয়েই মানুষ রেখে যায় তার পদচিহ্ন।
কিন্তু, নেহাতই এক তুচ্ছ, প্রান্তিক জীবনের সওয়ার কেউ কেনই বা নিজের কথা বলবে! কে শুনবে তার ফেলে আসা পথের বিবরণ! অতএব, সে বলবে তার সময়ের কথা, ফেলে আসা সময়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প। গল্পের কেন্দ্রে থাকবে সময়। বাস্তবের সেই গল্পে উঠে আসবে স্বাধীন দেশের এক প্রান্তিক মানুষের অসম লড়াইয়ের কথা। যে সময়ের কথা সে বলবে, সেটা এক অন্ধকার সময়ের গল্প, যে গল্পের কথক হিসেবে, চরিত্র হিসেবে এবং দ্রষ্টা হিসেবে, তারও অনিবার্য উপস্থিতি ধরা পড়বে নিশ্চিত। তবে, আগাম জানিয়ে রাখাই ভালো, এই দ্রষ্টার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার এই সাধারণ গল্পের অনেক চরিত্রই জীবিত রয়েছেন, অতএব সেখানে খানিকটা আড়াল থাকতে পারে, তাদের নিজস্ব জীবন পাছে উপলব্যথিত হয়। আর, কিছু একান্ত ব্যক্তিগত কথাও আপাতত উঠে আসবে না খুব সচেতনভাবেই, সেই একই কারণে। অনেক বছর পরে হয়ত গল্পের সেই সব অংশ জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। আপাতত যে আড়ালের চেষ্টা থাকবে, প্রয়োজন মিটে গেলে বহুদিন বাদে সেই আড়াল উঠে যাবে নিশ্চিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, স্বাধীনতা আন্দোলন, লাঠি-গুলি, বিপুল রক্তপাত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কারাবাস, নির্যাতন, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল আবহ, মন্বন্তর, দাঙ্গা-হিংসা, দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি, খণ্ডিত দেশ তথা খণ্ডিত বঙ্গভূমি...এসবই তার কাছে ইতিহাস মাত্র। তার ব্যক্তিগত বর্তমানের শুরু গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা কোচবিহারে। অসমে সম্প্রতি এনআরসি প্রক্রিয়ায় আবেদন পেশের প্রয়োজনে জরুরি কাজগপত্র তাকে জানান দিয়েছে, কোচবিহারে তার পৈত্রিক ভিটের সূচনা ১৯৫১ সাল। অতএব, পূর্ব পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। সবটাই বাবা-মা এবং সহোদর কয়েকজন দাদা-দিদির কাছে শোনা। কিছুটা তার বইপত্রে পাঠের অভিজ্ঞতা মাত্র। সেই সময়ের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর প্রাণ ধারণের লড়াইয়ের সহস্র বিবরণ অনেকেরই জানা। অসংখ্য বইপত্রে রয়েছে সেসব বিবরণ। ফলে, এই বিবরণের ক্ষেত্রে বাহুল্যবোধে সেই অতীত সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে চাই। এই বক্তা বরং কঠোরভাবে তার সময়েই অবস্থান করবে। জীবনের প্রথম পর্বে এই গল্পের শুরু তার কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যির বিকাশ ও স্মৃতিধারণ ক্ষমতার সময় থেকে। তবে, সরকারি নথি বলছে, কোচবিহারের এমজেএন হাসপাতালে সে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিল। কথায় বলি পৃথিবীর আলো, সে কথার কথা মাত্র। বাস্তবে এক শীতের রাতের অন্ধকারে সে এসেছিল এই পৃথিবীতে। তাই কি রাতের অন্ধকার তার এত প্রিয়! অন্ধকার রাতে তার প্রথম চোখমেলার ঘটনাই কি পরিণত বয়সে তাকে রাত চেনাতে সহায়ক হয়ে উঠেছে! মাঝে মাঝে ভাবি, এমনকি পেশাগত কারণেও তার জীবনে রাতের সঙ্গে এমন সখ্য গড়ে উঠেছে। ঘরের বাইরে, শহরের গভীর রাতের রাস্তাঘাট তার কাছে এক অন্য চেহারায় ধরা দিয়েছে। এরকম কোনো একদিন মাঝরাতে সরু প্রায়ান্ধকার গলিতে একা হাঁটতে হাঁটতে ধারালো উদ্যত তরোয়াল হাতে দুই অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের মুখ ঢাকা অবয়ব তার মনে ও শরীরে কী রকম স্পন্দন জাগিয়েছিল সে অভিজ্ঞতা বলা যাবে। যেমন বলা যাবে সংবাদমাধ্যমের অভ্যন্তরের নানা ঘটনা। আজীবন সংবাদমাধ্যমের কর্মী হিসেবে তার ঝুলিতে রয়েছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত নানা অভিজ্ঞতা। একটু একটু করে সেসব ঘটনা পেশ করা যাবে। আজ শুধু উল্লেখ করি, প্রবাস জীবনে তার কাছে মায়ের মৃত্যু সংবাদ টেলিগ্রাম মারফত এসে পৌঁছলে সে ছুটি চাইতে গেলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এখন ছুটি হবে না’! তার কাতর অনুনয়, ‘স্যর, আমাকে বাড়িতে যেতেই হবে’। কর্তা বললেন, ‘তাহলে আর ফিরে আসার দরকার নেই’! এক মুহূর্ত পরে, কী ভেবে বললেন, ‘পাঁচদিন। ব্যস। তার বেশি দেরি করলে চলবে না’। সেই সময় আরেক সহকর্মী কর্তার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। বাইরে এসে সেই সহকর্মীর মন্তব্য, ‘আমার বাড়া ভাতে ছাই দিলে!’ তার দুচোখে তখন আগুন জ্বলছিল। তাকে বললাম, ‘আমার মা মারা গেছে!’ তার মন্তব্য, ‘তাতে আমার কী?’
ক্রমশ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন