চা- পাতা ৯২

 


   সম্পাদকীয়    

  আমাদের জীবন মানেই তো এক লড়াই । আমাদের খাওয়া, শুতে যাওয়া, ঘুম সবকিছু যেন লড়াইয়েরই অংশ । আমাদের এই লড়াইয়ে ক্রমশ বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেকি প্রশাসন আর ক্ষমতাবান মানুষ । এই লড়াইয়ে কখনো জয় আসে । পরাজয় হলে সাগরদিঘিতে ভেসে ওঠে কচ্ছপের দেহ । জীবনে  চলার পথে কতকিছু দেখি । ট্রাফিকের হাতের লাঠি কিভাবে বিশ টাকাতেই হেসে ওঠে, দেখি আর বিস্মিত  হই । 


    গদ্য    

সুবীর সরকার

একবার হরি বল মন রসনা

১.
"একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না"

মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে । কিন্তু তখন
নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না।কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে । তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে।তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি।আর ভাঙা জলের  সোঁতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে।


২.
"নদিত ফোটে
নদীয়া হোলা"

চর তোর্সার সেই কবেকার জোড়া মহিষ আর সেই জুবুথুবু হতে চলা মৈশালের কণ্ঠের মৈশালি গান আজও ঘুর ঘুর ঘুর উড়ানি কৈতরের ডানায় ডানায় প্রবাহিত হতে হতে একটা নাচঘেরা গানঘেরা বাদ্যবাজনাঘেরা দিনদুনিয়া ফিরিয়ে আনতে থাকে।
চর তোর্সা থেকে উঠে আসে ধুলোর ঘূর্ণি। আর ঠিক তখন রসুনখেত থেকে জব্বার আলী শরীরে নাচের মুদ্রা এনে গান ধরেন-
"আজি ছাড়িয়া না যাইস
ও মোর চ্যাংড়া মৈশাল রে"

গান গানের মতন চলতে থাকে।আর বাওকুমটা বাতাসের মতন ঘুরে ঘুরে মরে সেই গান।
বাতাসের ভেতর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে উজানের মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই কবেকার জোড়া মহিষ।
এভাবে একটা দৃশ্য ঘোর নির্মিত বা বিনির্মিত হতে থাকে।চর তোর্সা জুড়ে কত কত পাখপাখালি উড়ে যায়।নদীর ছড়ার পাশে আমরা শুনি বগা বগির কান্দন।জীবন বেশ জীবন জীবন হয়ে উঠতে থাকে।
ফড়িঙের দোয়েলের ঘুঘুর জীবনের মতন বুঝি বা !


৩.
নন্দকান্ত বায়েনের সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হয়ে যায় শালকুমারের হাটে। নন্দকান্তর কাধে সেই চিরদিনের মস্ত ঢোল।সে তখন ইয়াকুব কবিরাজের গানের সঙ্গে নেচে নেচে ঢোল বাজাচ্ছে। কবিরাজের গান নন্দকান্তর ঢোল আর হাটের মানুষের জমায়েত এভাবেই একটা দৃশ্যকল্প রচনা করে ফেলতে থাকে।
হাটের মধ্যে একসময় ঢুকে পড়েন রতিরাম জোতদার তার মস্ত বিক্রম নিয়েই।এভাবেই জীবনের অন্দরে কন্দরে কিরকম একটা মায়াময়তা এসে পড়তে থাকে।
আর বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়ায় গান আর গান -
"আরো দিয়া যায়
পিরিতির বায়না"

এভাবে জীবন বাজে।
এভাবেই জীবনের পর জীবন বয়ে যায়।
পুরাতন দৃশ্যের পাশে চুপচাপ এগিয়ে আসে নুতন নুতন সব দৃশ্যাবলী।
আর চর তোর্সার কুয়াশায় খুব আবছা হয়ে হারিয়ে যেতে থাকে  নন্দকান্ত বায়েন আর তার ঘাড়ের চিরকালীন ঢোলটি, যা আসলে আখ্যানেরই অনিবার্য অংশ।


শৌভিক রায়

কথোপকথন

-- রাত কি দূরভাষী?
-- হয়তো বা তাই।
-- কোনও বার্তাবহ?
-- অবশ্যই।
-- বলতে পারো কী সেই বার্তা?
-- জীবনের।
-- কিন্তু রাত তো কালো।
-- জীবনের অঙ্কুরোদগমও তো কালোতেই!
-- মাতৃগর্ভ?
-- বীজও মাটিতে বপন করতে হয়। অন্ধকার তাও যে।
-- কিন্তু আলো তো দরকার।
-- জন্মের পর।
-- কী সেই আলো?
-- মুক্তির।
-- কিন্তু মুক্তি কীসে?
--- নানা মুনির নানা মত। আমি বলি অন্তে মুক্তি।
-- অন্ত মানেই তো শেষ।
-- শেষ থেকেই তো শুরু !
-- বৃত্ত একটা, যার শুরু শেষ কিছু নেই।
-- এভাবে হয় নাকি ?
-- কেন হবে না ?  বৃত্তাকার এক চক্র। কখনও শুরু মনে হয়, কখনও বা শেষ।
-- তার মানে তো সর্বদাই ঘূর্ণন।
-- সবাই তো সেভাবেই ঘুরছি।
-- যদি থেমে যাই !!
-- পারবে না। কোনোটাই তোমার হাতে নেই যে।
-- তবে এই যে তুমি?
-- আমি আছি, আমি নেই। তুমি আছো, তুমি নেই। সবটাই আপেক্ষিক।
-- তবে কীভাবে সম্ভব?
-- সম্ভব। সম্ভব একের নয়। যুথবদ্ধতার, যৌথের। জীবনের।
-- তাই বুঝি জীবন মনোহর?
-- আমি তো তাই বলি। জীবন মানেই উত্তরণ। মনোহর সে। ব্যথার। ভালবাসার।



       মুক্তগদ্য       


পিয়াংকী


কুন্দফুলের ঘুম আর একান্নটা চাবি

ধরো, গাছের কাছে রেখে এসেছি ঘুম । ধরো, নদীর জলে লুকিয়ে রেখেছি ক্ষমা । তারপর হেঁটে গেছি রাতের ওপর দিয়ে, ভোরের ওপর দিয়ে...  ক্রমশ।

ক্রমশ গাঢ় হয়ে এসেছে নক্ষত্রের রঙ গোধূলির ঘনত্ব। ঘনিষ্ঠজনেরা বলেছে,"ওদিকে যাস না বাঘে খাবে"। ঠাকুমার মুখে হাজার বার শুনেছি  যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয় (যদিও আমার ছোটবেলায় সন্ধে টপকে  সরাসরি রাত হত),সেইটুকু সঞ্চয় করে ক্রমাগত ঢুকে গেছি ভেতরে, আরও ভেতরে।

লোকমুখে কতকী ঘোরে,সেসব কথায় কান দিতে নেই।তাই  ফিরে আসি। প্রচলিত বাক্য, তোমরা প্রবাদ না কী একটা বলো।আমি বলি ফুলঝুরি। অপয়া আলো নাকি  ছিনিয়ে নেয়  স্নানের সরঞ্জাম,আমি না মানুষ বলে।শিউরে ওঠে ঘরের ভীত, ছিঁড়ে ফেলি বিগত  জন্মফুল।

"কথার ওপর  কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়"। অনুপম বলেন। আমিও বলি,শুধু পার্থক্য এটাই যে উনি সুরে বলেন আর আমি বেসুরে। শুয়ে থাকি। ছুঁয়ে থাকি ঘোরে অঘোরে। কেমন যেন স্থির হয়ে আসে বাইরের আবরণ অথচ গর্তের ভিতর তিরতির করে বয়ে যায় যে জল সেখানে কাঁপুনি। হাই ভাইব্রেশন।

দ্যাখো, চাঁদের থেকে আমি খাটো কিন্তু ,নিরক্ষরেখার মত সোজা।দ্যাখো, বিছানা থেকে আমি লম্বা,তবু  হাঁটু  মুড়ে রেখেও ঋজু
এই যে বিরাটকার মাঠ, এর উত্তর পশ্চিম কোণে বেড়ে উঠছে লজ্জাবতী 
যাবতীয় অভাব গাঁটছড়া দিয়ে পরপর বেঁধে রেখে কাঁধে ফেললাম একান্নটা চাবি। তালার সংখ্যা প্রকাশিতব্য

পরবর্তী অংশে...
ছায়ার কোনও নাম রাখিনি,সময় যত এগিয়েছে ততই ওজনে বাড়িয়েছি রুপোর নূপুর। জল থেকে খুলে রেখেছি জন্ম।অথচ কীইইইই বোকা আমি, ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি  কবে কখন কিভাবে আমার চোখে ও এঁকে দিয়েছে কুন্দফুলের ঘুম...




     কবিতা     


বিবেক  চৌধুরী

শ্রোডিংগারের  বিড়াল
       

ঝলকে ঝলকে নিষ্ঠা,শ্রম, দেশপ্রেম,
যোগ, কর্ম, মা-ফলেষু আওচার
মন্ত্রমুগ্ধ জিরাফদের মেধাবী করে দিচ্ছিলো,
কারণ তিনি কল্পতরু - হংস অবতার,
শব্দমাত্র তার মুখে হিগস্ বোসন...

ব্যাপারটা
সাপ্তাহিক স্তর থেকে মাসিক পর্বে নিয়ে গেলে
হজমের সুবিধা হয়।
এটুকু বলতেই তিনি অর্জুন হলেন।

গান্ডীবের ছটায় অন্ধ হতেই দেখি
কল্পতরুর বাচ্চা বিশাল মাল টেনে
বাঁশপেটা করছে তার বাপের গাড়িকে...



নবনীতা ভট্টাচার্য
যাপন

ঘোড়ার নালের মতো
সন্ধ্যা নেমে আসে
দুর্দান্ত পেঁচারা জোড়ায় জোড়ায় ওড়ে
টুপ করে শীত খসিয়ে আরও শীতল হয় কাঠের আবলুস
ব্যাঙের ঘুমের যাপন শেষে
পড়ে থাকে কয়েকটা ধানের শীষ।



পঙ্কজ ঘোষ
সম্পর্ক - ৪

দূরত্বেরা বিস্তৃত আজ আরও বেশি গাঢ়তর হয়
মুখোমুখি কথারা সব হঠাৎই সমান্তরাল যেন
আঙুলস্পর্শের দিন মৃত হয়ে স্তব্ধ রাত্রি নামে
ছন্দেরা ভেঙে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহুদূরে
যা ছিল সত্যি খুব আজ তারা বহুরঙে সেজে
এত বেশি নির্জনতা দোসর অসহনীয় অন্ধকার
তোমার যে মূর্তি গড়ি এখন ভীষণ অপরিচিত
সব ভুল সব মিথ্যে জানি এই গোধূলিবেলায়

পাতাঝরার মতো ঝরে যায় সমস্ত কথারা
জানি, আমাদের সম্পর্কেও বসন্ত এসেছে



অন্তরা চ্যাটার্জী

প্রতিদিন যেভাবে

ঘন কুয়াশার কাছে রেখে আসি অস্পষ্ট আলোর প্রতিবেদন
মুঠো খুলে উড়ে যায় ছায়ারঙ
ব্যথাতুর পলক, জড়িয়ে থাকে জোনাকির সহবাস।

প্রতিদিন আমি একটা একটা করে ভোর পেরোতে দেখি
দেখি, সুখ ভুলে উড়ে যাওয়া শঙখচিল
বাড়ির পাশে পড়ে থাকে আধখানা পথ,
সাদা কাগজে আঁকা তীক্ষ্ণ অভিমান।

মুখোমুখি হেঁটে যায় দূরত্ব...
তবু আমাদের বোঝাপড়া
একসাথে হেঁটে যেতে পারে না।


চা-পাতা

তৃতীয় বর্ষ ।। সংখ্যা - ৯২ ।। প্রচ্ছদ- উদয় সাহা


সম্পাদক - তাপস দাস 


.......................................................................................................................................



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১