গদ্য * সঞ্চালিকা আচার্য
সঞ্চালিকা আচার্য
অর্ধেক দেবী, অর্ধেক ডাকিনী
"বিচিত্রখট্বাঙ্গধরা নরমালাবিভূষণা।
দ্বীপিচর্মপরিধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।।
অতিবিস্তারবদনা জিহ্বাললনভীষণা।
নিমগ্নরক্তনয়না নাদ্যপূরিতদিঙ্মুখা।।"
ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপের দেনপাসার আন্তর্জাতিক বিমানবন্
জাভার রাজকুমারী মহেন্দ্রদত্তাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিয়ে দেওয়া হয় বালির রাজা উদয়নের সঙ্গে। কিন্তু সন্তান উৎপাদন ছাড়া আর কোন ভূমিকা তার ছিল না। অপ্রেম ও অসম্মানের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে আত্মসম্মান সচেতন মহেন্দ্রদত্তা দুর্গার উপাসনা ও সাধনা শুরু করে অমিত শক্তিধর হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভের আশায়। তবে সে আশ্রয় নেয় তন্ত্রসাধনা ও জাদুবিদ্যার। কিন্তু বেশিদিন এ কথা গোপন থাকে না, অচিরেই খবর যায় রাজার কানে। ক্রুদ্ধ রাজা উদয়ন ভরা রাজসভায় মহেন্দ্রদত্তাকে ঘোর অপমান করে এবং ডাইনি অপবাদে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেয়। রাজসৈন্যরা নির্মম অত্যাচার করে তাকে জঙ্গলে ফেলে চলে যায়। গভীর অরণ্যের অন্ধকার ও শ্বাপদসংকুল পরিবেশে মহেন্দ্রদত্তা ভীত হয় ঠিকই, কিন্তু অদম্য জেদে আবার উঠে দাঁড়ায়। শুরু করে ঘোর তান্ত্রিক সাধনা ও ডাকিনী আচার। এর কিছুদিন পরই বালিদ্বীপের অন্যান্য বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ প্রজারা মহেন্দ্রদত্তার খোঁজে জঙ্গলে আসে, রানির থেকে ব্ল্যাক ম্যাজিক শিখে নিজেদের শত্রুকে জব্দ করার আশায়। এভাবেই মহেন্দ্রদত্তার সাঙ্গোপাঙ্গ জুটে যায়, তারা ঘুরে বেড়ায় শ্মশানে মশানে। বালিদ্বীপের রানি হয়ে ওঠে অসুর ও ডাইনিদের অধীশ্বরী।
তারপর একদিন জানা যায় উদয়ন পুনর্বিবাহ করতে চলেছে। রাগে দুঃখে মহেন্দ্রদত্তা রাজার বিয়ে আটকাতে নিজের পুত্র ঐরলঙ্গের শরণাপন্ন হয়, কিন্তু পুত্র সাহায্য করতে অস্বীকার করে। এরই মধ্যে তার মেয়ে রত্নাকে অন্যান্য উচ্চবংশীয় ছেলেরা “ডাইনিপুত্রী” অপবাদে হেনস্থা করলে সে লজ্জায় অপমানে জঙ্গলে মায়ের কাছে চলে আসে। এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রোধোন্মত্ত মহেন্দ্রদত্তা ও তার দলবলের সম্মিলিত তেজে সমুদ্রস্ফীতি ঘটে, এবং দীর্ঘকালব্যাপী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যা, জরা, মহামারি ও মৃত্যু সমস্ত দ্বীপে ঘোর তমসাকাল ডেকে আনে। রাজা উদয়নেরও মৃত্যু হলে মহেন্দ্রদত্তাকে সংহার করতে রাজকুমার ঐরলঙ্গ শুভশক্তির প্রতীক ‘বারাং’-এর সহায়তা প্রার্থনা করে। বারাং ও মহেন্দ্রদত্তার দীর্ঘকাল যুদ্ধের পরেও কেউই পরাজয় স্বীকার করে না। বারাং মহেন্দ্রদত্তার ক্ষমতা টের পেয়ে বোঝে তাকে প্রশমনের একমাত্র উপায় হল আরাধনা। সে তখন নিজেই মহেন্দ্রদত্তার পায়ের কাছে বসে নতি স্বীকার করে এবং সকল দ্বীপবাসীকে অনুরোধ জানায় দেবীর আরাধনা করে তাকে সন্তুষ্ট করতে। এতে মহেন্দ্রদত্তা তৃপ্ত হয়, এবং প্রজাগণকে আশ্বাস দেয় যে যতদিন সে প্রজাগণের ভালবাসায় আরাধিত হবে, ততদিন দ্বীপবাসীদের কোন ক্ষতি সে হতে দেবে না। এভাবেই মহেন্দ্রদত্তা হয়ে ওঠে দেবী রাংদা। আজও বালিদ্বীপের অধিবাসীরা বিশ্বাস করে ভক্তিভরে দেবী রাংদার পুজোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানো যায়।
রাংদার আখ্যান লৌকিক হলেও চরিত্রগুলির উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও বালি একটি ব্যতিক্রমী দ্বীপ। সংকলিত ইতিহাস বলছে, মালয়-ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের তীরভূমিতে হিন্দুসভ্যতা আছড়ে পড়েছিল প্রথম সহস্রাব্দেই। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে ভারত থেকে আসা বণিক, পুরোহিত, শিল্পী ও পণ্ডিতদের হাত ধরে জাভা দ্বীপ হয়ে আরও পূর্বে ছড়িয়ে যায় হিন্দুসভ্যতার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বীজ। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুযায়ী এই সময়কাল থেকেই সূচনা হয় হিন্দু রাজবংশোদ্ভূত শাসন ব্যবস্থার। একইসময় প্রসার লাভ করে বৌদ্ধধর্ম, যদিও ৪১৪ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে চিনে ফিরে যাওয়ার পথের বর্ণনায় লেখেন “সেই সময় জাভায় হিন্দুতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদের তুলনায় বৌদ্ধ দর্শন ও সংস্কৃতি কিছুটা ম্রিয়মাণ ছিল।“ পরবর্তীতে অন্যান্য স্কলারদের মতে পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম আরও বিস্তৃতি লাভ করে। ভারত ও চিন থেকে আসা দর্শন, ধর্ম, শিল্প এবং সাহিত্যসংস্কৃতির অবিরোধী মিশ্রণ ঘটে এই দ্বীপরাষ্ট্রে। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অপূর্ব স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলাগুলি তারই সাক্ষ্য বহন করে। সঙ্গীত ও নৃত্যেও ভারতীয় প্রভাব বিদ্যমান। পনেরোশ শতাব্দী থেকে জাভা দ্বীপে শুরু হয় ইসলামীকরণ। হিন্দুরা ধর্মান্তর এড়াতে জাভা থেকে চলে আসেন বালিদ্বীপে। তারপর ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অধীনে থাকার পর ১৯৪৫ সালে দেশ স্বাধীন হয়। বর্তমানে এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যার পঁচাশি শতাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বী, যা ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যার ১.৭%। সহস্রাধিক হিন্দু মন্দির, যেখানে শিব, বিষ্ণু, রাম ও হনুমানের নিত্য আরাধনা।
রাংদার সমগ্র গল্পটিকে দুটি আঙ্গিকে দেখা যায়। একদিকে যেমন পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় বঞ্চিত ও অত্যাচারিত নারীর ক্ষমতার এক শক্তিশালী প্রকাশ লক্ষ করা যায় রাংদার চরিত্রায়নে, যেন প্রেম দিতে এসে শুধু প্রতারণা ও বঞ্চনায় অপমানিত নারীর ভীষণ জ্বলে ওঠা। অন্যদিকে তেমনই আবার এ যেন নিজেকে উজাড় করে দিতে এসে সভ্যতার হাতে ক্রমাগত লাঞ্ছনায় ক্ষুব্ধ পরমাপ্রকৃতির বীভৎস রূপ। তাঁর বহিরাঙ্গের রূপটি আমাদের চামুণ্ডাস্বরূপ। জরা, মৃত্যু, ক্ষয় ও ধ্বংসের প্রতীক যেন। আবার কোন কোন মূর্তিতে হাতের মুদ্রায় যেন অভয় ও বর দান করছেন, ঠিক যেমন আমাদের দক্ষিণাকালী মা শ্যামা। যে ভীষণরূপে শুম্ভনিশুম্ভনির্ণাশি, সেই মাতৃরূপে তিন লোকের কল্যাণকারিনী। আদিকাল থেকে ভারতে মাতৃপূজার চল ছিল, বৈদিক ও তান্ত্রিক উভয়মতেই। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতে আবিষ্কৃত প্রত্ননিদর্শনেও মাতৃপূজার প্রমাণ মেলে। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে যেমন দেবী ভগবতী, তেমনই শাক্তমতে মা-কালীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। তারপর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব দেখলেন মা ভবতারিণীর ত্রিলোকমোহিনী আনন্দময়ী মূর্তি। বললেন “শক্তিই জগতের মূলাধার, সেই আদ্যাশক্তির ভিতরে বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই আছে।“ এরই প্রকাশ যেন রাংদার বিগ্রহেও। মায়ের ভয়াল রূপটি তো আসলে বল্প্রদায়িনী, বীর-রসের উৎস। সেই মৃত্যুরূপা মাতার স্তুতি করে স্বামী বিবেকানন্দ লিখলেন তাঁর দীর্ঘ কবিতা কালী দ্য মাদার― “For Terror is Thy name/Death is in Thy breath/And every
shaking step/Destroys a world for e'er./Thou 'Time', the All-Destroyer!” অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা এই রূপ দেখেই মৃত্যুকে তুচ্ছ করতেন। এই শারদীয়া মহাপূজার প্রাক্কালে আজ আরও একবার নিজের মধ্যে সুপ্ত সেই আদি শক্তিকে জানার সময়, জাগিয়ে তোলার সময়― বাইরের অসুর নিধনে, ভিতরের অসুর দমনে।
“জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে॥
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥“
ভালো লাগলো সঞ্চয়িতা।
উত্তরমুছুন