২২।

প্রকৃতির মধ্যে লিপ্ত থেকে সে নিজেই আদ্যন্ত প্রাকৃতিক হয়ে ওঠে প্রকৃতির প্রাত্যহিক প্রাকৃ্তের মতো।ধারাবর্ষণের মতো সে প্রকৃতির ভিতর নিজের প্রাকৃতিক সত্ত্বাকে প্রতিস্থাপিত করলেও প্রকৃতির বাইরেও চলে আসতে হয় তাকে একসময়।যদিও এটাকে প্রকৃতির ভিন্ন এক প্রাকৃতিকতা হিষাবেই সে দেখতে চায়।তার দু’হাতের বলিষ্ঠতায় সে বুঝি আঁকড়ে ধরতে চায় জিন্দাপীরের মাজার।পীরের মাজারে সে বুঝি চিরাগও জ্বালাতে পারে!তার এই যাপনযাতনার সন্ধিক্ষণে যেন মহামড়কের চিল ওড়ে,হন্তদন্ত শকুনের লালাভ চোখে জন্মজন্মান্তের এক ঘোর খেলা করে যায়।সে কি তবে মাজারমুখি রাস্তা বেয়ে যেতে থাকবে পোড়াকাঠ সংগ্রহের ব্যাগ্রতায়।প্রাকৃতিক হয়ে ওঠাটাকে সে নিজেই একধরনের রূপকথায় রূপান্তরিত করে নিতে চাইলেও গভীর কোন অপ্রাপ্তিজাত ব্যর্থতাবোধ তাকে কুরে খায়।সে আবহয়ান এক প্রকৃতির প্রাকৃতিক পর্বান্তরে কথান্তরে চলে যেতে চায়।তখন জ্যোৎস্নালোকে পীরের মাজার শোকসংগীতের মতো অন্তহীন খানাখন্দের জালকের জটে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে।নিজের সকল সত্ত্বাকে প্রশ্নাতীত কোন নিরপেক্ষতায় দাঁড় করিয়ে দিতে চাইলেও সেই সাহস কি সে অর্জন করতে পারবে।গঞ্জমেলায় জিলিপির দোকানের সামনে দিয়ে আসাযাওয়াসূত্রে সে কিন্তু প্রকৃতই কোন জিলাপিপ্রীতি আয়ত্ব করতে পারে না;বরাবরের দইচিড়াতেই আত্মগত হয়।চরিত্রের এই সারল্য,দোলাচল তাকে প্রাকৃতিক করে তোলে।প্রাকৃতিক সত্ত্বার স্থয়িত্বস্থিতির ঘুরপথে সে তার নির্ভরতার চরমতম যায়গাগুলিকে গোপন সিন্দুকের নিঃসঙ্গতা থেকে যেন মুক্তই করে দেয়।প্রকৃতির মধ্যে লিপ্ত থেকেই তো সে প্রাকৃতিক হয়ে উঠতে পেরেছে।স্তব্ধতার ভাষাপুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে জীবনমরণের মধ্যবর্তীতে সে জীবনভর হেঁটে গেছে।তার পায়ের পেশীসকল লোকায়ত পথঘাটে ঘুরে মরতে মরতে একধরণের গতানুগতিকতার ধন্ধগোলকের দীর্ঘ টানেলে স্তব্ধতার মতো প্রতিবিম্বিত হয়েছে।জন্মভর তার চংক্রমণকে সে আঞ্চলিকতার এক ইতিহাসধারায় আটকে রাখতে চায় নি বলেই তো স্বয়ং এক পুরাণ হয়ে উঠতে থাকে;এটাই তার প্রকৃতির প্রাকৃতিক হয়ে ওঠাটাকে মান্যতা দেওয়া কিংবা অগ্রাহ্য করবার অন্থস্থ স্বভাবজাত মহামহিমতা, যেন সে ঘনঘন হারিয়ে যেতে চায় শালফরেষ্টের বন্যতায়।শুরু ও শেষ নিয়ে তার অতিক্রান্ত দিনগুলি তার দিনযাপনকে অমোঘ সূর্যালোকের মতো মাদকতাময় করে তুলতে থাকলেও সে দেখে মরিচের গাছে হেলান দেওয়া রতিকান্তর শেষুয়া বেতার বৌ পটেশ্বরীর একান্তে একা একা গেয়ে ওঠা বিয়ের গীতের কয়েক কলি।সবকিছুর ভিতর দিয়ে সে কি বন্যতাকে পুনরাবিস্কৃত করে,যেভাবে শহরের রাস্তায় একদা উঠে এসেছিল বন্যবরাহেরা।চিৎকৃত শব্দময়তায় সে তার অবসন্ন হয়ে পড়াটাকে অবসাদের পরিণতিত্বের দিকেই বোধহীন নিয়ে যায় শ্রাবণজলধারার ঘরোয়া একমুখি ভঙ্গিমার মতো।তখন পীরের মাজারে ক্রমে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকেন,দোয়াদরুদ আওড়াতে থাকেন লোকশ্রুতির জিন্দাপীর;সফেদ ঘোড়সওয়ার হয়ে যিনি রাত্রির সমস্তটুকু জুড়ে প্রকৃতির প্রাকৃতিকতায় নিদারুণ উড়ে বেড়াবেন আগুনবাতাসধূলোমলিনতাকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই।

২৩।

টাড়িবাড়ি ময়নাতলী হেলাপাকড়ি সাহেবপোঁতা টংঘর শিকারবাড়ি মাহুতবন্ধুর গান লাল টিয়া হস্তীকন্যার হলুদ খামার বিবাগী বাইসন কিংকোবরার ফোসফোস--সমস্ত অনুসঙ্গপ্রবাহে ভেসে যেতে যেতে সে পরিভ্রমণের পাকেই যেন আশরীর ডুবে যায়।এই নিমজ্জনের গল্পের পাকে তাকে অবশ্যম্ভাবিই ঘুরে ফিরে আসতে হয়।এভাবে পুরাণপুরুষের ছদ্মবেশে সে তার জীবনযাপনের ছন্দ প্রকরণশৈলি নিজেরই আত্ম  অবস্থানের ধোঁয়াশায় মিশ্রিত করে দিয়ে নিমজ্জনের অতিচেনা পাকেই নেমে যেতে থাকে।এ যেন পালাগানের রঙ্গীলা আসর,আসরবন্দনা দিয়ে যার উন্মোচন।উন্মোচিত হবার পর্ব থেকে পর্বান্তরে সে নদীমেঘবাজনার সমান্তরালে লুপ্তকালীন কোন গানই বা সম্ভবত গল্পের পাকের আদিমতা খুঁড়ে তুলে আনতে চায়।তার চাওয়াটাকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে ভাবতে সে বিষধর সাপের সহসা জেগে ওঠার সতর্কতাকে প্রতক্ষ করতে থাকে সচেতনভাবেই।তখন লোকত্তর এই পৃ্থিবীর বুকের গহন থেকে লাভাস্রোতের মতো হিলহিল অগ্নিফুলকিরা যেন তার সমগ্রতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে লোকত্তর পৃথিবীর দূরবর্তীতায় বজ্রপাত ঝড়ঝাপট সহযোগে পুনর্বার লোকলোকত্তরের মহাস্থবিরতাকে চোরাবালিতে ডুবতে বসা কোন মানুষের বিপন্নতা আর্তি মরনোন্মুখ অসহায়তার গভীর গোপন কথকথায় জেগে থাকতে চায়।এভাবে,এইরকমভাবে সে নিজেই অজ্ঞাতে অজান্তে পূর্বপ্রস্তুতিহীন সময়প্রবাহে যেন হাজার হাজার বৎসরের অতিকথা কিংবদন্তির বীজখেতে হালুয়া চাষার মতো ত্বরায় নেমে আসে অতিকথার সদাপীড়িত উপকাহিনির সূত্র ধরে ধরে।শ্যাওলার মতো এক অতিপিছলসবুজ মানুষে রূপান্তর ঘটে যায় তার।রূপান্তরের তালগোলপাকানো পটভূমির ভিতরে সে এসে দাঁড়ায়।তার এই কিংবদন্তিতে পরিনত হওয়াটাকে সে সামগ্রিকতায় বোধের সানুদেশে নিয়ে আসে যেন নিমজ্জিত হওয়ার প্রতীকতাকে ধানমাঠ বর্ষার জমা জলে আকাশের মেঘভরতি ছায়ার সংকেতের সাথে অদলবদল করে দেয়।সংশ্লেষণের এই রীতিনীতি নিয়ে সে হাওয়াবাতাসে ঘুরে বেড়াতে থাকলেও কিংবদন্তির আলোঅন্ধকার থেকে সে পরিত্রাণ পেতে পারে না কেবলই পরিত্রাণহীন কথান্তরের ডিঙিনৌকোয় নিজেকে জলবিষাদের তাল লয়ে ঢেউদেশে ভাসিয়ে দেয়।জীবনমরণের বেঁচে থাকবার আত্মিক প্রয়োজনে সংকটে সে কেবল ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে চায়।লোকমানুষের পৃথিবীতে তার কিছুই নয়,সে কেবল বিষাদটুকুই অর্জন করতে চায়।অর্জিত করতে চায়।অর্জিত অভিজ্ঞতার সাথে সে কি পরোক্ষে বিষাদলিপ্ত হতে পারবে!সে কি আগুনের হা-মুখ থেকে শীতরাত্রির পারিবারিক গল্পগুলিকে আগুণ জ্বেলে মশাল দুলিয়ে দূরের কাছের সব হাতিখেদানো গ্রাম বস্তির দৃশ্যকাব্যগুলিকে সংগ্রহ করতে পারবে!অসহায়তা দিয়ে ক্লান্তি-অবসাদের সকল অনুভব দিয়ে সে কি চলে আসতে পারবে দৃশ্যসীমার নাগালে।এতশত সংশয় প্রতিপল তৈরী হবে,তাকে ঘিরে ধরে আচ্ছন্নও করে ফেল্বে,কিন্তু সংশয়াতীত এক আত্মগত ঔদাসীন্যে সে সবকিছুকেই অগ্রাহ্য করে লোকপুরাণের আবহমানতায় যাবতীয় কিংবদন্তিসহ লোকপুরানের ভিতর হেঁটেই যেতে থাকবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১