চা পাতা।। ৫৬
চা পাতা। ২য় বর্ষ । সংখ্যা- ৫৬ |
সম্পাদকীয়
এই বেঁচে থাকার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই । তাই এই তীব্র অসুখের মধ্যেও আমরা লিখছি, গান গাইছি, কবিতা পড়ছি। এটাও এক লড়াই। চলুন ভালো থাকি।
মনোজ পাইন
ধ্রুব পত্র
অনেক স্মৃতিতে ভরপুর হৃদয়, তবুও মেঘ
পরিপাটি বারান্দায়। আমি আন্দাজ মতো
বেঁচে আছি। আগত বিপর্যয়ের স্বপ্ন, ভীতি
আমাকে প্রতিদিন চেটেপুটে খায়। প্রান্তিক
জীবন এখন পুরোপুরি নগর জীবনে ছেয়ে
আছে। স্মৃতি তো এখন ফেলে আসা গ্রাম,
যার উৎপাদনে বার্ধক্য বসেছে।
জানো, অদ্ভুত নিয়মে আমি আবিষ্কার করেছি
যে প্রেমে আমি নিজেকে এত কাঙাল ভাবি ;
সে জীবন আমার থেকে দূর, বহুদূর। জেনে
রাখো, যে স্বপ্ন, যে ভয়ে আমি ঘুমোতে পারিনি
সেখানেই আমার দুঃখিনী কুড়েঘর প্রতিদিন
আশার প্রদীপ জ্বেলে যায়!
মনে রাখো, ধ্রুব শব্দে আমার নিয়ত প্রীতি
ঘৃণা শব্দ আমার থেকে যথারীতি দূর!
কিছু মানুষ
আমার মস্তিষ্কে মৌরলা মাছের স্বাধীন সাঁতার ছিল
ধ্যানে ছিল ক্যাকটাসের শেকড়
শিশুর মত বিশ্বাস নিয়ে খুঁজেছি
দেশ এবং মানুষের সমানুপাতিক সম্পর্ক
আজ সাঁতারের পুচ্ছে সুতোর পিছুটান
বাতাসের কান ভাঙিয়েছে ওজনের ষড়যন্ত্র
বিশ্বাস পুড়ে গেছে
ছাই উড়ছে রুদ্র আকাশে
দেশ ও দ্বেষের ব্যাস্তানুপাতিক হাওয়া ওড়াচ্ছে
কিছু মানুষ---মানুষের সৎভাই
দুটি কবিতা * অভিজিৎ দাসকর্মকার
সাক্ষাৎকার
চোখের জলে লাল জামার চেকের রেখাজুড়ে ঘাস আর রাজনীতি মাথা দোলাচ্ছে ———
হাসিতে লাল জয়পুরি ছাপের অপেক্ষা, ব্যালকোনি, এলোমেলো ভিজে যাওয়া ২৪-প্রহরের রাস্তা____
আলোকিত উপখ্যানে কেবল গুমরে ওঠা পরেরদিনের সহযাত্রা।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম চোখের শব্দের অজান্তে,পরনে ১০২.৫° F জ্বর
মাথার পাশে পরাচেতনার রাত এবং কুঁচকানো বিছানা আর নিয়তি খামচানো যন্ত্রণা।
শরীরজুড়ে শিরোনামহীন জরিপের কাঁটাখোঁচা,
বাথরুমে যাই
হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসি শরীর
দেনায় ডুবে যাওয়া রক্তে, চাপ বাড়ছে, পাস্কাল আর অ্যাভগার্ড্রো মুখোমুখি ____
একটু দাঁড়ান আপনারা———
সাদা সাদা কথা গুলো এখনো বলা হয়নি, চিল্কার সাথে বারবারই মিশে গেছে রেচনজল, এবং
মুখোশের সাক্ষাৎকার...
প্রতিবেশীর গীতি-আলেখ্যটি
পেশেন্সের ভিতর আমি একা হয়ে পড়েছি
বেরিয়ে আসে অনুভূতি আর চোখের জল,
খালি ধূ-ধূ ছায়া আর আকতার বেগমের গজল
সেখানে বাজতে থাকে সান্ধ্যভ্রমন, নক্ষত্র আর বৃষ্টিজল
সাথে প্রতিবেশীর গীতি-আলেখ্যটি।
ছাদে মূল্যবান বশ্যতার কাছে নতিস্বীকার করে চলেছে দাবার বিশপ।
জ্যোৎস্না আর ডাকবাক্সের চিঠি হয়ে নেমে আসে নায়াগ্রার জলপ্রপাত, বাড়ির বাইরের দিকের রেলিঙের শান্ততা ছিলো, আজ
সেখানে সানাই, ইমারত আর শান্ত মুখমণ্ডলে বলিরেখার অবয়ব ঘুরছে______
মাথা নামিয়ে ঢুকে যায় পরগোত্র।
নিঃসঙ্গ যুবক, খয়েরি চেক জামা, সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া,
অথচ তখনও পূর্ণিমা বাউল গান গাইছে।ক্যানোনা আমার হাসপাতাল সেই না পাওয়া হাসিটি———
দুটি কবিতা * পহেলী দে
শঙ্কিত মনে
একটা আতংক, একটা মৃত্যুসম যন্ত্রণা
বিঁধে আছে কণ্ঠনালীতে,
একটা দুর্যোগ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঘরে বাইরে।
তারে কইতে গেলে বাজে, সইতে গেলে লাগে।
মনে হয় এই বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
এই বুঝি নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসলো
অনামিকা, মধ্যমা, কনিষ্ঠতমারা
চিরকালের বিশ্বস্ত পাঞ্জা টুটি টিপে ধরলো
আততায়ী পরজীবী সম্মোহন মেনে।
আয়নার মুখোমুখি দাঁড়ানো নিজেকেই—
মনে হয় মৃত্যুদূত
এখনই ধরে নিয়ে যাবে বহুদূরে বরফের দেশে
তারপর সাজিয়ে রেখে দেবে সারিবদ্ধ সংখ্যার সঙ্গে
শীতল গণকবরে।
কেউ ছোঁবে না, কোথায় যাচ্ছ, ফিরে এসো বলে
হাউমাউ করে কাঁদবে না কোনো প্রিয়তম স্বজন
এমন মৃত্যু, এমন অশুচি প্রস্থান কেউ চায় না।
বর্শার ফলা হয়ে প্রিয় ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে
শুভ্র হিমেল স্তব্ধতা।
হয়তো কেউ বাদ যাবে না অন্তিম ছোবল হতে
ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে পৌঁছে যাবে
অন্তরীণ যত গ্রাম গঞ্জে, নগর বন্দরে।
এ অনন্তযাত্রার কোনো ভূগোল নেই
নেই মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, গীর্জার ভেদ।
এক কাতারে দাঁড়িয়েছে আল্লাহ, ভগবান, বুদ্ধ, যীশু, জিউস, এথিনা, আফ্রোদিতি।
তবু সকাল রোজ উঁকি দেয় পূবের জানালায়,
দখিনা পরশ বুলায় শঙ্কিত মনে
ঘুরে দাঁড়াবে মৃত্যুমুখর পৃথিবী।
সঙ্গনিরোধ
বাঁচো প্রাণ বাঁচো,
খেয়ে না খেয়ে বাঁচো,
দূরত্বকে ভালোবেসে বাঁচো,
সঙ্গনিরোধে বাঁচো,
প্রিয়মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচো,
প্রিয় চোখে দৃষ্টি রেখে বাঁচো,
জন্মদায়িনী জননী ও জনকের জন্য বাঁচো,
আত্মজ ভবিষ্যৎ ভেবে বাঁচো।
বেঁচে থাকার বিকল্প কিছু নেই,
তুমি ছাড়া কে আছে পৃথিবীর মূল্য বোঝে?
মা ছাড়া সন্তান যেমন ভাসে অথৈ সাগরে
অন্ধকার ব্যতীত আলো যেমন অর্থহীন
তেমনি তুমি ছাড়া পৃথিবীও অচল মুদ্রা।
একটি সোনালী সুদিনের কথা ভেবে
পূর্ণিমা সন্ধ্যায় সমুদ্র ভাসানের স্বপ্ন দেখে
পাহাড় চূড়ায় এক আজলা মেঘের কথা ভেবে
জল ও হিজলে টলমল হাওরের কথা ভেবে
অনাদরে বেড়ে ওঠা দরিদ্র ভূখন্ডের কথা ভেবে
জেগে থাক দূরে বহুদূরের তারাদের সাথে।
আরো কিছুকাল ঘুমাক পৃথিবী
বড্ড ক্লান্তি নিয়ে শয্যায় গেছে সে,
জানালায় যেটুকু আকাশ চোখে পড়ে
যেটুকু জোছনা বিছানায় গড়াগড়ি দেয়
আপাতত এটুকুই সঙ্গী হোক সঙ্গনিরোধ সময়ে।
কোথায় তুমি একা?
চোখ বন্ধ করো, ধীরে ধীরে শ্বাস নাও
আয়নার সামনে ঘন হয়ে দাঁড়াও
দেখ প্রেম দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে
তোমাকে স্পর্শ করে যে বাতাস
এই মাত্র উড়ে গেল দক্ষিণে
তাকে ছুঁয়ে দিল প্রবালদ্বীপের ঝড়।
ঝড়ের শেষে রূপালী ভোরে ফোটে অখণ্ড আকাশ
বুক পেতে রাখ উত্তরের শ্মশানে
যেন অফুরান প্রাণশক্তি দেখে পালিয়ে বাঁচে মৃত্যু।
সপ্তর্ষি বণিক
টু দা পয়েন্ট
মুখোশের ভেতরে মুখোশ আরো স্পষ্ট হচ্ছে
জল থেকে তুলে আনছি জীবন
কাঁটাতার লাগিয়ে দিচ্ছি
নিজস্ব উঠোনে
ভয় ও মৃত্যুর মাঝে ঝুলে আছে
আমি
রূপকের আড়ালে ঘুম স্পষ্ট হয়
রূপকের আড়ালে কান্না স্পষ্ট হয়
রূপকের আড়ালে মৃত্যু স্পষ্ট হয়
সেইদিন রবিনবাবুর দাওয়ায় গল্প হচ্ছিলো
রাজবাবুর বাড়িতে বসেছিলো কবিতা আসর
আজ,
প্রতিটি বাড়ির ভেতরে কবিতার আসর
গল্পের আসর
পৃথিবী ক্রমশ একা হচ্ছে
আমরা থেকে আমি হয়ে যাচ্ছি
ঘুম পাতলা হচ্ছে
ভয়ের থেকেও মৃত্যুভয় বড়
ভয়ের থেকেও মায়াজন্ম বড়
ভয়ের থেকেও আনন্দ বড়...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন