দোতারা।। ৬ষ্ঠ পর্ব।।


 গোয়ালপাড়ার লোকগানের রানী প্রতিমা বড়ুয়া


মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু তার স্মৃতি।আবার মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার স্মৃতি।স্মৃতি আমাদের কাঁদায়,হাসায়,দূরাগত করে তোলে।50 ছুঁতে গিয়ে আজকাল স্মৃতির ধূসর তাঁবুর ভেতর আমি ঢুকে পড়ি।কষ্ট হয়।আনন্দও হয়।কত কত স্মৃতি জড়িয়ে এই যে অন্তহীন বেঁচে আছি আমি!জীবনের মূল্যবান স্মৃতিগুলোকে নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবছি লিখবো।মনোবেদনার দহে ভাসিয়ে দেব কাগজের নৌকো।সেটা 1996 সাল।অসমের গৌরীপুর শহর।গৌরীপুর মানে একশো বলির দুর্গাপুজো,রাজা প্রভাত বড়ুয়া,রাজকুমারী নীহারবালা বড়ুয়া,রাজকুমার প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া আর লালজি রাজার ছড়িয়ে থাকা মিথগুলির শরীরে হাত রাখি।আমার বন্ধ চোখের সামনে ছুটে আসে সেই কবেকার এক পৃথিবী থেকে হাতি মাহুত ফান্দি আর হাতি মাহুতের কত কত গান।ইতিমধ্যেই প্রমথেশের 'মুক্তি' ছবিতে দেখেছিলাম রাজকুমার পিসি বড়ুয়ার প্রিয় হাতি জংবাহাদুরকে।যাকে নিয়ে রচিত হয়েছিল গোয়ালপাড়ার লোকগান, কালী দাশগুপ্ত যা সংগ্রহ করে গেয়েছিলেন-
'বালাকুঠির ওরে টোকন ব্যাপরী
তেরশো টাকা দিয়ে ব্যাপারী 
কিনিয়া রে আইনছেন হাতি
আরে জংবাহাদুর হাতির নাম
তেরশো টাকা হাতির দাম
ওরে কামাই কাজে যেমন তেমন
মানুষ মারার যম'
গৌরীপুর মানে সরু ফিতের মত গদাধর নদী।ছবির মত সুন্দর নদীর বাঁক।আর রাজকুমারী প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া।গোয়ালপাড়ার লোকগানের রানী।লোকজীবন জুড়ে যাকে সবাই ডাকতো 'আজার বেটি' নামে।একসময় জড়িয়ে পড়লাম প্রতিমার সঙ্গে আত্মীয়ের মতন।শনিবার চলে যেতাম গৌরীপুর 'মাটিয়াবাগ প্রাসাদে'।মধ্যরাত পর্যন্ত লোকগানের ঢেউ।জীবনের গল্প শোনাতেন তিনি।শিল্পীর বা স্রষ্টার যাপনের যন্ত্রণার কথা।পাথারবাড়ির হাওয়া হাহাকার নিয়ে ঢুকে পড়তো সেই টিলার উপরের রাজবাড়ীর ভিতর।বিমল মালির কাঠি ঢোল, অনিলের দোতরা,সিতানন্দ বুড়োর সারিন্দা।সাথে দেশী মদ, নাসিরউদ্দিন বিড়ি আর চারমিনার সিগারেট।লাওখোয়ার বিশাল বিলের দিকে উড়ে যেত উড়ানি কৈতরের দল।আর গান গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তো গৌরীপুর শহরের আনাচে কানাচে-
'গদাধরের পারে পারে রে
ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি
কি মায়া নাগাইলেন মাহুত রে'
কিংবা-
'নাল টিয়া কি টিয়া রে
ও তোর ভাসা নলের আগালে
বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে'
ব্রহ্মপুত্রের চরে চরে কত ঘুরেছি প্রতিমার গানের দলের সাথে।দেখেছি কি অসামান্য জনপ্রিয়তা তার ভুমিলগ্ন জনমানুষের মধ্যে।প্রতিমা গান ধরলেই ফাঁকা গানবাড়িতে লহর উঠতো।মানুষ চোখে জল নিয়ে ডুবে যেতেন প্রতিমার গানে-
'হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামনের নারী
মাথায় নিয়া তামকলসি ও
সখী হস্তে সোনার ঝাড়ি
খানিক দয়া নাই খানিক মায়া নাই
মাহুতর লাগিয়া রে'
আমৃত্যু সম্পর্ক ছিল প্রতিমা বড়ুয়ার সঙ্গে।আমার জীবনে প্রতিমা বড়ুয়া এক অসামান্য শিক্ষক।অসামান্য প্রাপ্তি।তার কাছ থেকেই লোকমানুষের যাপন ও গাননাচকে প্রবল ভালোবাসতে শিখেছি।আমার জীবন ও জীবনবোধ ধারালো হয়েছে ক্রমে ক্রমে।ভরে উঠেছি।পূর্ন হতে পেরেছি।
প্রতিমাকে গৌরীপুরের চিতায় তোলা হচ্ছে আর একশো লোকশিল্পী একযোগে দোতরা বাজিয়ে গাইছেন-
'তোমরা গেইলে কি আসিবেন 
ও মোর মাহুত বন্ধু রে'
এমত দৃশ্য ভাবা যায়!একজন লোকগানের রানীকে রাজকীয় বিদায় জানাচ্ছেন সহশিল্পীরা!
'ও জীবন রে জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে
তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে আদর করিবে কায়
                                               জীবন রে'

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১