রবিবার কবিবার


২৫ আগষ্ট ২০১৯                               রবিবার - ১৬


নমস্কার উজানদা চা পাতা'র রবিবার কবিবার সাক্ষাৎকারে আপনাকে স্বাগত জানাই।

প্রশ্ন - আপনার কাছেই প্রথমেই জানতে চাইব কিভাবে লিখতে এলেন আর কবে থেকে লিখছেন?

উত্তর  - ছোটবেলায় ওই ধরো, সিক্স বা সেভেন- বৃষ্টির দিনে ভিজে ভিজে স্কুল যেতে যেতে ভাবতাম, পাখিদের বাসায় জল- দেখতাম বানভাসি মানুষের চোখ শুকিয়ে যাচ্ছে, বাবাকে দেখতাম মানুষের পাশে-

অপু দূর্গা শরতের কাশ প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু দিদিমণি বন্ধু সীতাংশু আচমকা নিখোঁজ হওয়া - পড়ার খাতার পিছনে হিজিবিজি লিখতাম।

স্কুলের ইংরেজি ও বাংলা স্যরদের সাথে বিজ্ঞানের স্যরদের আমাকে নিয়ে টানাপোড়েন।
লিখতাম, অঙ্ক করতাম, সমীকরণ সাজাতাম - কল্পনায় আঁকি বুকি কৈশোরের খেলার মাঠ।

এভাবেই শুরু। তারপর ফিজিক্স পড়া, প্রেসিডেন্সি, থিয়েটার, শর্ট ফিল্মের কোর্স আর জীবনানন্দ শক্তি  বিনয় জয় বোদলেয়ার -

কবিতা লিখতে শুরু করা সিরিয়াসলি এবং কবিতা ঈশ্বরীর খুঁজে পাওয়া শয়নে স্বপনে ঘুমে জাগরণে।

প্রশ্ন -  আপনার অনুপ্রেরণা কারা? কোন কোন অগ্রজ কবিকে পাশে পেয়েছেন লিখতে এসে?

উত্তর  - জীবনানন্দ বিনয় শক্তি ভাষ্কর রণজিৎ দাস অনুপ্রেরণা। আরও অনেকে। কবি মাত্রেই ঈশ্বরীর দূত - এভাবেই ভেবেছি।

অনুপ্রেরণা- তো যাকে যাকে পেয়েছি চলার পথে সব্বাই দিয়েছেন।

নাম বলে শেষ হবেনা। তবুও সাহিত্যের শিক্ষকেরা এবং সহকর্মী কবি রণদেব দাশগুপ্ত,  সামিরুল হক শ্যামল মল্লিক, সুপ্রিয়া সু চক্রবর্তী, রমা সিমলাই, উত্তম দত্ত,  বিনায়ক দা, অজিতেশ দা, ঋজুরেখ দা, হেমন্ত সরখেল, শাশ্বতী ভট্টাচার্য, পিয়াঙ্কি, দেবযানী, কৌশিক, অরিজিৎ, উজ্জ্বল, সর্ভানু, দিলীপ ভঞ্জ, তাপস দাস, অনিমেষ, সুজিত দা, দীপঙ্কর দা, কাকলীদিভাই, শ্রাবণীদি, তানিয়া, শ্রীলা, দেবলীনা, জয়তী, এছাড়াও প্রচুর অগ্রজ কবি অনুজ কবি বন্ধুরা উৎসাহ দিয়েছেন।
অগ্রজরা যারাই আমাকে স্পর্শ করেছেন, উজার করে দিয়েছেন তাদের ভালোবাসা স্নেহ।

সবচেয়ে বেশি প্রেরণা পেয়েছি নিজের কাছ থেকে।
কবিতার মেয়ের কাছ থেকে। আর আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে।

প্রশ্ন . আমার মতে উজান উপাধ্যায় একজন কবিতা পাগল মানুষ।  একদিনে একাধিক কবিতা লেখেন কি করে?

উত্তর - না লিখলে মরে যাব বলে। না লিখলে ঈশ্বরীটা পাগল করে দেয় বলে। আর কবিতা তো সংখ্যার নয়, সে তো গণনার আওতাধীন নয়- মৌলিক বিন্যাসের সামঞ্জস্য ভেঙে একের ভিতরে অসীমের আকাঙ্ক্ষা, শূন্যের মধ্যে ভেসে চলা আবহমান- একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ।

প্রশ্ন . আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি?  আজ অব্দি কয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর - "আশ্চর্য ফেরোমন" প্রথম উদ্যোগ, যদিও আগেই প্রকাশিত হয় বুকর‍্যাকে নৌকাপিয়ন।
পাঁচটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে।

"পোস্টকার্ডেরা হারিয়ে গেছে", "শূন্যে ছড়ানো বোধিগাছ", "শূন্যজার অসম্ভব মেঘবাড়ি"- এই তিনটি নিয়ে মোট পাঁচ।

প্রশ্ন . শুরুর দিন থেকে উজান উপাধ্যায়ের জার্নিটা কেমন?

উত্তর - প্রতিদিন নতুন জন্মগ্রহণ। প্রতিমুহূর্তে আরও অন্ধকারে আলোর নাভিবিন্দুর সঞ্চরণ। ক্রমাগত অনেকের অসংখ্যে জড়িয়ে যেতে যেতে নির্জনে একাকী খুঁজে পাওয়া কবিতার মেয়ের বারোমাসের সংসার।

অরৈখিক আবর্তে দিনযাপনের অন্তর্বাস, দেহছালের বৃষ্টিদাগে বিষণ্ণতার অভাবনীয় পারিজাত সুবাস-নিজস্ব নদী পাখি প্রেমিকা ও প্রেমিকদের নিয়ে জন্মদাত্রীর সুবিশাল পরবাসে পাহাড়ি বন্য ফুল পাতা সাঁকো মই - বেশ একটা পান্থনিবাস ছেড়ে আমিত্বের কারাগারে লুটোপুটি,জলোচ্ছ্বাস -- এবং আমাকে খোঁজা আমিত্বের ক্ষুদ্রতা ছাড়িয়ে এসে।

বন্ধুতা ও সংশয়, কল্পনা ও সত্যি মিথ্যের অনর্থক বিলাসিতা থেকে মুখ সরিয়ে উন্মাদের কল্পনাবিলাস।
সমাজ নেই, সময় নেই, স্থান কাল পাত্র নেই শুধুমাত্র বৃদ্ধনামার গন্ডিদাগে ভালোবাসার অস্থানিক রূপান্তরে গাছজন্মের হাপিত্যেশ খুঁড়ে অমল সুধার অনির্বাণ বিরল পায়েস-ওষ্ঠভাঁজে মৃত্যুর রোমান্টিক গানে জীবনের মায়াবী উপরিপাতন।

প্রশ্ন . চলতি দশকে যারা বাংলা কবিতা লিখছে তাদের লেখায় কী কী নতুনত্ব দেখতে পাচ্ছেন?

উত্তর - বহুমাত্রিক চলন আর শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিনবত্ব, সময়ের কথা বলার চেষ্টা।

প্রশ্ন . একজন কবিকে কেমন মানুষ হতে হয়? 
উত্তর - এ প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব মজা লাগবে। কবিকে মানুষ কতটা হতে হয় জানিনা তবে কবি না হওয়াটা খুব জরুরি।

আর মানুষ। কবিরা বড্ড বেশি মানুষ হতে চান। কলমে। কলমের বাইরে তাদের এ বিষয়টা অধিক ক্ষেত্রেই ধোঁয়াশায় ভর্তি।

পুরষ্কার, এওয়ার্ড , সম্মান আর। পিঠ চাপড়ানি তে গিলে না ফেলে-

রাস্তায় তেল থাকলে এবড়োখেবড়ো পথ ধরা আবশ্যক।

প্রশ্ন . আপনি কবিতা লিখতে লিখতে, অথবা একটি কবিতার আশায় সারারাত জেগে থাকেন আমি জানি, তারপর যখন কাঙ্খিত লেখাটি লিখতে পারেন কেমন লাগে?

উত্তর - মনে হয় এবারের মতো মরে গেলে কোনও আক্ষেপ নেই। যদিও লিখে ফেলার পর আরও একটা কবিতা ঘুরঘুর করতে থাকে। ওরা মোটে তিষ্ঠতে দেয়না আমাকে। কবিতার আকাঙ্ক্ষা বড্ড সর্বনাশা, কাজেই কোনও হিসেব বেহিসেব কাজ করেনা। মনে হয়, যে লিখছে সে অন্য কেউ- জন্ম শংসাপত্রে যে আমি কে পেয়েছিল এই গ্রহ, সে লোকটি কবি নয়-সময়ের নীল গর্ভে অস্থির পরম অধিবাস সেই কবিটির।

প্রশ্ন . যদি বলি কেন লেখেন, কি বলবেন?

উত্তর - জন্মসূত্রে পাওয়া গ্রহজীবনের যেটুকু অসুখলীন স্বপ্নের স্পর্শকাতর গতিবিধি, তার চারপাশে গড়ে তোলা যে মহাজীবনের দৃষ্টিপথ - কবিতা লেখা শুধু সেই বহুবর্ণী, বহুদিশার দোলাচল, স্বতঃস্ফূর্ত অটোনমাস স্পন্দন-দেশ রাষ্ট্র মানুষ প্রেম হৃদয় ভালোবাসা এবং রাজনীতি -প্রতিবাদ বিপ্লব অতিক্রম করে একটি অন্য দুনিয়ার অভিবাসী হওয়ার লক্ষ্যে।

আমিত্বের গন্ডি থেকে খন্ড অখন্ড বিমূর্ততা মূর্ত জীবনের পরিসর উৎক্রম করে পৌঁছে যায় ছুটি আর মৃত্যুর পরমে।

এই জন্য লিখে ফেলি অমর্ত্য ভ্রমণ আর বৃষ্টিস্নান, কৈশোরের স্মৃতি শৈশবের সবুজ পোস্টকার্ড।
ডানা আসে শূন্যতার গন্ধ নিয়ে, মহাকাশে উড়তে থাকে বহুবীজ বুকে জড়ো করা জন্মোত্তীর্ণ দোয়াত কলম।
যে কবিতা লেখে তার তো পিতা মাতা শুরু শেষ কিছু নেই-

সে আছে লক্ষ বছর, যেখানে অ্যামিবাও ছিল, পরজীবী ছিল - যেখানে ঈশ্বর ছিল না- মানুষের তলপেটে নিয়ত রসায়ন ছিল জলবায়ুর বরফশীতল মগজের সাথে হৃদয়নগরের দর্পণ আখরে।

প্রশ্ন.  একজন কবি হিসেবে আপনি কিরম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন?

উত্তর - একদম যে দ্বিতীয় পৃথিবীটায় মানুষ কখনও নিজের কথা ভাববেনা, ভালোবাসায় তার সবটুকু বেঁচে থাকা, বন্ধন যার মুক্তির সারস্বত শিরোনাম।
যেখানে আকাশ মানে শুধুই উড়ান, মেঘ মানে দুষ্টু বালিকা, ঋতু মানে চক্রে বসে ব্যূহ ভাঙার চঞ্চলতা।

প্রশ্ন . সোশ্যাল মিডিয়া কি কবিতার ক্ষতি করছে, কি মনে হয় আপনার?

উত্তর - হ্যাঁ।

প্রশ্ন . আপনি একজন শিক্ষক,আপনার সহকর্মী - ছাত্র এরা আপনার লেখালেখিকে কিভাবে দেখেন?
উত্তর - অদ্ভুত অদৃশ্য দেখে ফেলা। পরিমাপের ষড়যন্ত্র, ভালো মন্দের আবদ্ধ চরাচর।

তবুও তাদের আবেষ্টন অভাবনীয় এক পাওয়া।

প্রশ্ন . আপনার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা আপনার লেখালেখিকে কতটা সাপোর্ট করেন?

উত্তর - অসম্ভব।

প্রশ্ন.  কোন লিটল ম্যাগ করার ইচ্ছে আছে কি?
উত্তর - না।

প্রশ্ন . একদম নতুন যারা লিখতে এসছে তাদের কি বার্তা দেবেন।

উত্তর - কিছু পাওয়ার লক্ষ্য ত্যাগ করুন। না লিখলেই নয়, বরং বর্ণমালা মায়ের জরায়ুর থেকেও নিশ্চিত আলয়-

ভাঙুন, খবরদার গড়তে যাবেন না।

প্রশ্ন . চা পাতা'র পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
উত্তর - চা শুধু পানীয় নয়, তা আসলে একটা নির্মাণ - ভোর আর সকালের পার্থক্য বুঝে নেওয়ার একটি জ্বলন্ত সিলিন্ডার।

তোমাদের ভালোবাসা।

অনেক তো বকলাম আবোলতাবোল, হবে নাকি এক কাপ চা-
পর্ণমোচী গাছের গভীরে পরিযায়ী জীবনের সবটুকু মৃত্যুর কোলে আদুরে ভাঁজের সাথে জড়িয়ে যে চা পাতা মহাজীবনের বার্তা ছড়ায়।
ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা।

অনেক অনেক ধন্যবাদ উজানদা,  আপনার ব্যক্তিগত জীবন ও কবিতাজীবন আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধ হোক। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা পাতা সাপ্তাহিক