ধারাবাহিক আত্মজীবনী। সুবীর সরকার


১৯।

চিলাপাতার হাটে ঢোল বাজাতে বাজাতে আমার নিকটবর্তী হয়েছিল জার্মান রাভা।আন্দুবস্তীতে হাড়িয়া খেতে খেতে কত কত বছর আগে জার্মান তার জীবনের নানাকিসিমের গল্প শুনিয়েছিল।কত কত বাদ্যগান মোরগলড়াই কবরখানা ধামসা মাদল!এক ফাঁকে জেনেছিলাম শিবজির বৃত্তান্ত,যাকে গিলে ফেলেছিল মেন্দাবাড়ির হাতি।মাঠে মাঠে ঘুরি।ছড়ানো রোদের মায়ায় ভরভরন্ত শীতকাল।নকসাদার।অপরূপ।প্রান্তিক সব গঞ্জবাজারে উত্তরজনপদের,নিম্ন অসমের নদীজলবাতাসে পুষ্ট হতে হতে কেমন এক চিরকালিনতাই এসে যায় বুঝি।কত সম্পর্ক।বর্ণময় এক জীবনই তো যাপন করি।

অসমের গৌরীপুর।সাদা ফিতের এক নদি গদাধর।লাওখাওয়ার বিল।৩০০ বলির দূর্গাপূজা।রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া।রাজকুমার প্রমথেশ।লালজি রাজার গল্পগাথা।আর হস্তির কন্যা প্রতিমা বড়ুয়া।জনশ্রুতিতে ‘আজার বেটি’।গৌরীপুরের পথে পথে হাঁটি।পাগলের মত হাতি খুঁজি।সেই সব মাহুতফান্দীদের খুঁজি।আমার শরীর জুড়ে গোয়ালপারিয়া লোকগান।কাঠি ঢোল।মায়াময় এক জীবন নিয়ে আমার গতজন্মের ‘মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি’।বিমল মালির বাজনা বাজে,বাজে সীতানন্দের সারিন্দা।প্রতিমা বড়ুয়ার গানের সুরে সুরে আমার আবহমানের অনুভুতিময় স্মৃতিকাতর কুয়াশাঘেরা জীবনের দিনগুলি জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে।তুমুল এক শীতরাতে রাজবাড়ি থেকে বিমল মালির সঙ্গী হয়ে ফিরছিলাম।বিমল শোনাচ্ছিল প্রতিমার নেশাময় জীবনের হরেক গাথাগল্পগুলি।প্রতিমার জীবন,তার গান,গানময় বেঁচেবর্তে থাকবার আর্তি প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল।নাসিরুদ্দিন বিড়ি আর দেশী মদ খতে খেতে হাতিমাহুতের সে এক অন্তহীন পৃথিবী-

   ‘ও তোর মাহুত চড়ায় হাতি

  গদাধরের পারে পারে রে’



২০।


সে এক অদ্ভূত মানুষ!যার সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না কোনদিন।যার জন্য মন কাঁদে,বুকের ভিতর আশ্চর্য মোচড়।রাজশাহী শহরে পদ্মার পারে তার সাথে দেখা।সম্রাট স্বপন।পেশায় রিক্সাচালক।পদ্মাচরে বাড়ি।বন্ধু কবি মাসুদার রহমান ও আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দেখা পেয়ে যাই সম্রাটের।ওর রিক্সায় পরবর্তী ৩ দিন আমরা অন্তহীন ঘুরে বেড়াই।সম্রাট স্বপন ভবঘুরে,উদাসীন স্বভাবের।কিভাবে যেন আত্মীয়তায় বেঁধে ফেলে সে আমাদের।আমরা স্বপনের নদীচরের বাড়িতে যাই।বড্ড মায়াময় এই জীবন।হা হা হাসতে হাসতে প্রবল গান গেয়ে ওঠা সম্রাট স্বপনের।

আবার হেরম্ব বর্মণ কে কি করে ভুলি!সাহেবপোঁতার হাটে,পাটকাপাড়ার হাটে টর্চলাইট বিক্রি করত হেরম্ব।সে ছিল আমুদে,রসিক মানুষ।কোচবিহার রাজার শিকারযাত্রায় হাঁকোয়ালি করত।‘কুষাণ পালায়’ ছুকরি সেজে খোসা নাচতো।আবার হেমন্তের সদ্য কাটা ধানখেতে ঘুরে ঘুরে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে নিয়ে আসতো।হেরম্ব গল্প বলতো,যেন বহুপ্রজ এক কথোয়াল!পুরোন দিনের সব ধনীজোতদার,কোচবিহারের রাজারাণীরাজকুমারেরা কী জীবন্ত হয়ে বর্তমানে ফিরে আসতো যেন।

২১।


দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টির হচ্ছিল।বৃষ্টির ভিতর মৃত দিদির মৃতদেহবহনকারী আমরা।দিদির মৃতমুখ বেদনাবাহী বৃষ্টিকণায় মিশে যেতে যেতে কেমনতর এক শোকগাথা হয়ে দিদিকে নিয়ে লেখা যাবতীয় এলিজিতে গিয়ে ঝাঁপ দেয়।

গল্পের পাকে পাকে,স্মৃতির পাকে পাকে জড়িয়ে যাওয়া জীবন।অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে না!নদীতীরের বাতাসে তিরতির কেঁপে ওঠা জীবন।কাঠামবাড়ির জঙ্গল ভেঙ্গে হাতিরা বেরিয়ে আসে,হাঁটতে থাকে গজলডোবার দিকে।আমি বুঝে ফেলি,দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙিলা দালানের মাটি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১