চা-পাতা ৯৪

 



ম্পাদকীয় 

     শ্মশান বানানটা ভুল লিখতাম একসময় । আমাদের উচ্চারণ অনুযায়ী শশান হয় তো,  তাই শশানই লিখতাম । কিন্তু এই এক বছরের মধ্যেই বানানটা টপকে শব্দটাকে বুঝে ফেলেছি । শ্মশান আসলে জীবন নামক গল্পটির  উপসংহার । শুকনো ও কাঁচা বাঁশ, পাঠকাঠি, আম্রপল্লব, ঘি পুড়িয়ে শেষ লাইন লেখার একটা প্রয়াস ।

  গ্রামের কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা জীবনে অনেক মরা পুড়িয়েছেন , তাদের বিশ্বাস একশো মৃতদেহ সৎকার পূর্ণ হলে মহাপূন্য লাভ করবেন । ‘আমারও এদিনটা আসবে’ বলতে বলতে তারা আগুনে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া দেহপিন্ডটিকে খোঁচা মারতে থাকেন, দেহ গলে গলে পড়তে থাকে । তাদেরকে আমার খুব জ্ঞানী মানুষ বলে মনে হয় । তাদের শরীরে অনেক অজানা অক্ষরের হাঁটাচলা লক্ষ্য করা যায় ।


মোস্তফা মঈন
গাছভাই

তোর সামনে দাঁড়ালে নিজেকে মানুষ মনে হয়।
বল তো এতো ভালোবাসিস ক্যান ?
জন্মসূত্রে
আমি কি ছিলাম জানি না । তোকে গাছ জেনে
তোর ডালে উঠে ঝাঁকুনি দিই জীবন
আর তুই ফুল ও ফল ঝরাস !
আমি তোর ডাল কেটে নিই, পাতা ছিঁড়ি—  তোর বাধা নেই ।
প্রতি বসন্তে নতুন নতুন পাতা দিস
জানি, তোর কচি পাতারা নিঃশ্বাসের ভাষা দেয় ।
আমাদের বেঁচে থাকার আশ্বাস দেয় ।
তবুও তোকেই চেরাই করি, ফাড়ি, পালঙ্ক বানাই—
আয়েশ করে পাছার তলায় তোর মরা হাড়গোড় রেখেই
সেক্সো ফলাই
বল তো আমি কে ?
গাছভাই !
----------------------------------------------------

মনোজ পাইন
যে বাড়ির পথটি ফুলে ভরা

(উৎসর্গঃ কথাকার সুকান্ত নাহাকে)

ফুলেল পথের বাড়িটিতে ঢুকে দেখি
সেখানে সঞ্চিত রাখা আছে ওম
পরতে পরতে
পরিপাটি যত্নে রাখা
বীরভূমের বীরত্ব
পুরুলিয়ার প্রবল জেদ,
বাঁকুড়ার জন্য মঙ্গল ধ্বনি।
ডুয়ার্সের  কান্নাও 
তার গোপন হৃদয়ে বাজে।

বাড়িটির চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নীল  রঙের পাহাড়
তার নিচে দাঁড়িয়ে কিছু লোক রোমের কথা বলছিল
আমি তাদের বলি
যে বাড়ির পথে দাঁড়িয়ে ফুল অভ্যর্থনা জানায়
সেখানে রোমও ম্লান।
আমি জেগে জেগে স্পষ্ট দেখি
বাড়িটি হঠাৎ বোধি বৃক্ষ হলে
তারই নিচে
শান্তির জন্য  তথাগত তপস্যায় বসেছেন ।

--------------------------------------------------------

তুষারকান্তি রায়
শাম - এ - গজল

হাসতে হাসতে খালি হয়ে যাচ্ছে
হেমন্তের দিল - আসমান...
ফিসফিস স্বরে ভেসে যাচ্ছে বেদম বাতাস  ;
যাক,  উড়ে যাক  --  এলোকেশী রাস্তার গাছ
টপটপ ভিজে যাক মিনিবাস স্ট‍্যান্ড ,
চৌমাথার শের -ই - পঞ্জাব ...
ঘুপচির পানের দোকান ।
ভাঙা শক্তিগড়ের মেলায় ভিজে যাক
জবজবে টিপের পাতা , নেলপালিশ,
আয়না , ন‍্যাপথলিন, মোবাইল কভার ...
ল‍্যাম্পপোষ্টের ছানিপড়া আলোর নিচে
হেলান দেওয়া পল্টুদার
যৌতুকে পাওয়া সাইকেল
ফিরে যাক কলোনির চারাঘরে
টিমটিম আলো জ্বেলে অপেক্ষায় থাকুক
ঘরের লক্ষ্মীমনি নতুন বৌ  ;  আর
ক‍্যারিয়ারে বাজতে থাকুক শাম - এ - গজল

--------------------------------------------------------

সৌমাল্য গড়া
রমণীয়

স্নেহকলসের পাশে রেখেছি আনত
মুঠি, যদি ছুঁতে পারি আমিও শিশুর
সঙ্গ পাব। আমি হব একাধারে পিতা ও সন্তান
ঘুম থেকে উঠে ফিরে যাব গর্ভগৃহে
লেখা নেই শরীরের যেসব অজ্ঞাত গুপ্তধন
উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে খুঁজব প্রতিক্রিয়াশীল
সেইসব গোপনতা, চরম জাগাবো
শরীরের উপর শরীর, মেঘে মেঘে ভেঙে দেব
সমস্ত দুয়ার। মুহুর্মুহু বৃষ্টি আর ক্ষণিক তফাতে
ঠোঁটের নৌকাটি দুলবে সংশয়ের ভারে
স্পর্শের মুহূর্তকাল আগে মনে হবে
স্তন নয়, কাঁপে তার হৃদয়ের কালো
দুটি চোখ!

-------------------------------------------------

নাদিরা
কাফন

এই পূর্ণিমা বা আগামী যেকোনো পূর্নিমায়
আকাশের গা থেকে চাঁদ খসে যাবে,
ভেঙে যাবে দেহ তার প্রিয় কোনো ক্ষেতের পরে
আলো বা আঁধার মিশে গল্প হবে মাঘের ;
সেই দিন ভোরবেলা এলো চুলের কিশোরীর প্রেমিক হারিয়ে যাবে!
চাঁদ-মাঠ-ঘাট-নদী হন্যে হয়ে খুঁজে কাঁদবে...
আমরা দেখব তরুনীর তলপেটে মিশরের মরুভূমি জন্মালো কিনা ....

একদিন এভাবেই ছোটোবেলার কোনো বৃদ্ধ বেড়ালের দেখা পাবো
জীবন শুনব - জীবন বলব- চা-বাগানের মতো ধাপে ধাপে কাঁদব ।
বেড়ালের ঘোলা চোখে সেদিন হয়তো থাকবে অপ্রাপ্তির দীর্ঘ মায়া
অথবা আমারই ভুলভাল বয়সের মায়া...
তারপর, সবাই ভুলে যাবে_ কাফন পরার পর সৌন্দর্য বাড়ে কিনা!
আমি প্রতিদিন শৈশব নিয়ে ঘুরি- প্রতি বিকেলে তেরো বছরের সূর্যের মৃতদেহ পোড়াই...

-------------------------------------------------------



               ধারাবাহি দ্য                        
  
  
সমর দেব 
 আমার যে দিন ভেসে গেছে

                                          

            ২.


           সেই ষাট বা সত্তরের দশকের পশ্চিমবঙ্গে যারা জন্মেছিলাম তাদের পৃথিবীটা পরবর্তী প্রজন্মের তুলনায় একেবারেই অন্যরকম ছিল। আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রের সেই বিশেষ বিন্যাস আমাদের মন-মানসিকতা গড়ে দিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ষাটের শেষদিক এবং সত্তরের দশকের প্রথম পর্বে শৈশব কেটেছে যাদের, তাদের দেখা পৃথিবীতে যে তীব্র আশার আলো প্রকট হয়ে উঠেছিল, সেই আলোয় প্রায় সকলেই উজ্জীবিত কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করেছিল। সমাজের সবচেয়ে বড় অংশটি ছিল হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত তথা নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেকারণেই সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদেরই প্রাধান্য ছিল। জীবিকা ছিল কঠিন, দুঃসাধ্য, কখনও প্রায় অসাধ্য। সেই সময়টিকে সঠিকভাবেই তাঁর সিনেমায় তুলে এনেছিলেন মৃণাল সেন। ‘কলকাতা ’৭১’ মোটেই শুধু কলকাতার সামাজিক ছবি নয়, বরং, সমগ্র বাংলাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছিল মৃণাল সেনের এই ছবি। সেকারণেই, সেই কালসন্ধিলগ্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচিত সবাইকেই এই ছবিটি দারুণ আকর্ষণ করেছে, এমনকি আজও। সন্নিহিত বাস্তব মানুষের চেতনায় যে গূঢ় ছাপ রেখে যায়, সেই ছাপ আজীবন তাকে আলোড়িত করে। তাই, সেই স্বপ্নের দশকের বাঙালির শুভাশুভ বোধ, তার নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধে সুস্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে সংশ্লিষ্ট সময়। রাজনীতিতে এই চেতনার প্রতিফলন দেখা গেছে। এমনকি, বাম নামধারী রাজনৈতিক দলগুলির জোট বামফ্রন্ট কয়েক দশকে একেবারে পচে হেজে গেলেও দীর্ঘ চৌত্রিশটি বছর দিব্যই ক্ষমতায় টিকে ছিল এবং এর পেছনে সক্রিয় ছিল ষাট-সত্তরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপুষ্ট এক বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বপ্নচারণা! যদিও তারই চোখের সামনে বাম নামধারী দলের নানা স্তরের নেতা-কর্মীরা চরম অধঃপতিত হয়েছে, তবুও তার মনের গভীরে কোথাও একটা স্বপ্ন নিঃসন্দেহে লুকিয়ে ছিল। তাকেই নিপুন কৌশলে বছরের পর বছর ধরে ব্যবহার করে গেছে শাসক পক্ষ। ভয়াবহ বেকারত্বের চাপে সমাজ দিশাহারা। শিক্ষিত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অংশটি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়ালে সরকার স্বভাবতই প্রবল চাপে পড়ে যায়। পরিস্থিতি একেবারে বিস্ফোরক হয়ে ওঠার আগেই সরকারি উদ্যোগে আয়োজন হতে থাকে ‘বেকারি বিরোধী দিবস’!  এবং প্রতারণা বুঝতে পেরেও মানুষ চুপ করে থাকে। কারণ, তখনও তাদের চেতনায় কংগ্রেস দল তথা সরকার এবং একদা মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্তশঙ্কর রায় নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের ভয়ানক সন্ত্রাসের স্মৃতি জীবন্ত রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেছে। তারপর, দুই কমিউনিস্ট পার্টির ভাবনাচিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, পরিকল্পনা, কার্যকলাপে বিরক্ত, অসন্তুষ্ট একাংশ দল থেকে সরে আসেন। কৃষক আন্দোলনকে সামনে রেখে তাঁরা নতুন করে লড়াইয়ে নামেন। তাঁরা সত্তরের দশককেক মুক্তির দশকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আর, সেই পরিস্থিতিতে বাংলায় নেমে আসে ভয়ানক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ১৯৭১ সালে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে গেলে দেশ জুড়ে জারি হয় জরুরি অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী তখন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং পশ্চিমবঙ্গের মসনদে কংগ্রেসেরই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। বিষয়টি নিয়ে অজস্র বইপত্র রয়েছে। সকলেরই সেসব তথ্যপাতি কম-বেশি জানা। ফলে, নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কিন্তু, সেই সময়ের প্রেক্ষিতেই কংগ্রেস সম্পর্কে বাংলার জনমনে যে ঘৃণা, বিদ্বেষের জন্ম তাকেই চমৎকার পুঁজি করতে পেরেছিল বাম দলগুলির জোট। কেন্দ্রের বঞ্চনা তখন ছিল এক জনপ্রিয় লব্জ। এমনকি, বৃষ্টিতে ক্রিকেট মাঠে খেলা পণ্ড হলেও দোষারোপ করা হতো কেন্দ্রকে। কেন্দ্র টাকা দেয় না, অতএব ‘রক্ত দিয়ে বক্রেশ্বর গড়বো’!  নিত্যনৈমিত্তিক এরকম নানা স্লোগানের ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল বাংলার আকাশ। সব বুঝেও ষাট-সত্তরের জাতকদের পক্ষে কিছু করার ছিল না। কারণ, বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হলে কারা আসবে ক্ষমতায় ? ইতিমধ্যেই মুক্তির দশকের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। বাংলার মানুষের সামনে বাস্তবিকই উন্নত কোনও বিকল্প তখন নেই। অথচ, তৃণমূল স্তরে অন্যায়, অবিচার, নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা, ভয়াবহ সব অপরাধ ক্ষমতাসীন বাম দলগুলিকে বছরের পর বছর ধরে একেবারে ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছে। তবু অসহায় মানুষ মন্দের ভালো বামফ্রন্টকেই আঁকড়ে ছিলো বছরের পর বছর। তারপর, একদিন খুব সঙ্গত কারণেই ভেঙে পড়লো সেই তাসের ঘর।

        বামফ্রন্ট সরকারের সুদীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের শাসন পশ্চিমবঙ্গের সমাজকে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আর, তারই ফলে বিজ্ঞান বিরোধী, যুক্তি বিরোধী, দক্ষিণপন্থী ভাবাদর্শের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেসের দুঃশাসন প্রবল নেতিবাচক সত্ত্বেও মানুষের স্বপ্নগুলো তখনও বেঁচে ছিলো। বাম শাসনে লুম্পেনরা সব বাম দলেরই প্রতিটি স্তরে ঢুকে পড়ে আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্ত কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে এবং দল ও প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় সীমাহীন বর্বরতার জেরে সাধারণ জনমনে ঘৃণার জন্ম দেয়। তারই পরিণতিতে ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তারপর দুটি নির্বাচনের শেষ দেখা যাচ্ছে বাম দলগুলির একেবারে মুছে যাবার মতো অবস্থা।

              এই পশ্চাৎপটেই আমাদের প্রজন্মের সমস্ত অর্জন। আমাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, আশা ও আশাভঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাখ্যান, আনন্দ ও  বেদনা, নীতি-নৈতিকতা, ক্ষোভ ও ক্রোধের কার্যকারণ তুলে ধরা উচিত বলে মনে করি। নইলে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের পথপরিক্রমার স্তরে স্তরে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তার মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। তবে, এই ধারাবিবরণীর পরবর্তী পর্যায়গুলোতে আর্থ-রাজনৈতিক তথা সামাজিক জটিলতার আর উল্লেখ থাকবে না। যদিও প্রতিটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে জীবনের ভৌতবাস্তবের আপাত অস্পষ্ট চোরা টান। এবং, দূর শৈশবের অনেক স্মৃতি এখনও স্পষ্ট অনুভববেদ্য, অতএব কোনও একটি সূচনাবিন্দু থেকেই সেসব প্রত্যক্ষ বাস্তব, যেমনটা নিজে দেখেছি, অনুভব করেছি,  তুলে ধরবো।

        স্মৃতির প্রসঙ্গে মনে পড়লো জীবনের প্রথম উজ্জ্বল একটি ঘটনা। তখন দুপুর। একটু আগেই মা গায়ে ছোবা ঘষে ঘষে স্নান করিয়ে দিয়েছে। আমি ঘরের ভেতরে এসে কাঠের পুরনো, প্রায় কালো হয়ে যাওয়া, খয়াটে আলমারিটার একটা পাল্লা খুলেছিলাম কেন কে জানে !  আর তারপরই প্রবল বিস্ময়ে আবিষ্কার করি, আলমারির তাকে অনেক বই-খাতা। বইগুলো বেশ মোটা মোটা। একটা টেনে নামাতেই কয়েকটা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে। চরম বিব্রত দশা। কেউ টের পেলে পিঠের ছাল তুলবে, জানি। আতঙ্কে প্রায় কান্না পেয়ে যায়। কিন্তু তখনও কাছাকাছি কেউ ছিলো না। একটু সামলে উঠে একটা একটা করে বইগুলো তুলে রাখি। অদম্য কৌতূহলে খাতার (ছোট এক্সারসাইজ বুক) একটা তুলে নিয়ে আলমারির পাল্লা বন্ধ করে সেখান থেকে পালাই। তারপর পা টিপে টিপে পাশের বাড়ির বিশাল কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে পাতা উল্টোতে থাকি। নীল কালিতে লেখাগুলো একটু জড়ানো জড়ানো। একেকটি শব্দ একেকবারে এবং কখনও পরের শব্দটিও সেভাবে এক টানে লিখলে যেন জড়িয়ে যায়। প্রথম পাতায় লেখা ‘গোপালচন্দ্র দেব’। আমার বড় মামা, শুনেছি। ইহজন্মে তাঁকে দেখিনি। খাতার প্রতিটি পাতায় দুপাশে মার্জিন ছেড়ে লেখা। সেসব যে কবিতা, সেটা বোঝা গেলো কারণ, ওপরে স্পষ্ট লেখা ‘কবিতা সংগ্রহ-২’। তাহলে, ‘কবিতা সংগ্রহ-১’ নিশ্চয়ই থাকবে। কয়েকটা পাতা পরপর পড়ে গেলাম। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা গেলো না। কিন্তু, আমার সমস্যা ঘোরালো। এই খাতা সবার চোখ এড়িয়ে ফের যথাস্থানে রাখবো কী করে ? শরীরে লুকনোর মতো কোনও ব্যাপার নেই। কারণ, একমাত্র ইজের পরিহিত, ঊর্ধ্বাঙ্গ আদুল শরীরে গোপনতার কোনও অবকাশ নেই ! এই ভয়ানক বিপদে দুহাত পেছনে নিয়ে খাতাটা যতটা সম্ভব পাছায় চেপে গুটি গুটি ঘরে ঢুকি। নাহ, কেউ দেখেনি ! তারপর, খুব সাবধানে আলমারির পাল্লা খুলে সেটা যথাস্থানে রেখে দিই। কিন্তু মাথার ভেতরে তখন তুমুল ঝড়। বড় মামার কবিতা !  বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না আমার। কেমন একটা অহঙ্কার হচ্ছে। অথচ, কেউ জানে না। কাউকে বলাও যাবে না। কারণ, ওই বয়সেই জেনে গেছি, মারগুলো কখন কোনদিক দিয়ে আসবে কেউ জানে না, আমার জ্ঞাত কোনও কারণ থাকুক বা নাই থাকুক। স্মৃতির সূচনাবিন্দু থেকে আজ অবধি অজস্র মার খেয়েছি এই জীবনে। সেটা সবসময় শারীরিক নয়। কিন্তু প্রায়ই সেটা শরীরকে ছাপিয়ে জীবনকেই রক্তাক্ত করেছে, বিপন্ন করেছে, বিধ্বস্ত করেছে।

       

 

  ক্রমশ...

মর দেব
               জন্মঃ ১৯৬৩ সালের ১ নভেম্বর, কোচবিহারে। সাংবাদিকতার পেশা সূত্রে গুয়াহাটিতে বাস করেন ।  কবি, কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৫ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে সমর দেবের 'আলো অন্ধকার' কাব্যগ্রন্থের কবিতা ইংরেজি অনুবাদে পেশ করে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মন্তব্যঃ ‘ইউরোপ-আমেরিকা শিখুক এই বাঙালি কবির কাছে’। কথাশিল্পী সমর দেবের উপন্যাস অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি, অসম সরকার কর্তৃক ভাষা গৌরব সম্মাননা লাভ করেছেন। 

তাঁর প্রথম উপন্যাস পরিপ্রেক্ষিত, ১৯৮১ সালে লেখা এবং শিলিগুড়ির অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রবিশ্ব পত্রিকায় ১৯৮৬ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ যযাতি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের তালিকায় রয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যযাতি' ছাড়াও এক যুগ আত্মপ্রতারণা (উপন্যাস), একটি গল্পের সুলুক সন্ধান (উপন্যাস), লঙ্কাবরের উমেশ মাঝি (উপন্যাস), নীল অন্ধকার (উপন্যাস), লোহিতপারের উপকথা (উপন্যাস), আম্মা তেরা মুন্ডা (কাব্যগ্রন্থ), আলো অন্ধকার (কাব্যগ্রন্থ), বহুদর্শী কাক ও অন্যান্য কবিতা (কাব্যগ্রন্থ) এবং একমাত্র প্রবন্ধ সংকলন অমৃতযাত্রা।


      *********************************
               

      চা পাতা 

চতুর্থ বর্ষ । সংখ্যা - ৯৪

প্রচ্ছদ  - দেবমিত্রা চৌধুরী  

সম্পাদক- তাপস দাস 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১