নবীন লেখক বনাম প্রকাশক 

শৌভিক রায়

বই। ঝকঝকে কাগজে কালো অক্ষরে মুদ্রিত শব্দেরা, তকতকে প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদে বইটির নামের নিচে লেখক বা কবির নাম। একজন নবীন লেখক এই স্বপ্নটা বুকে পোষেন লেখা শুরু করার প্রথম দিনটি থেকে যে, তার নিজের অন্তত একটি বই হবে।

বাঙালিদের সম্পর্কে একটি কথা চালু রয়েছে। প্রতিটি বাঙালিই নাকি জীবনে কোনো না কোনো সময় টিউশন করেছেন ও কিছু না কিছু (বিশেষ করে কবিতা) লিখেছেন। লেখালিখির পর্বটা যারা একান্তই ছাড়তে পারেন নি, তারা আর একটু এগিয়ে বই-প্রকাশ অবধি গেছেন। বই নিয়ে আমরা এতটাই সংবেদনশীল যে, তথ্য প্রযুক্তির এই বিস্ফোরণের যুগেও বই আমাদের প্রথম পছন্দ। অথচ আজ লেখা প্রকাশ করা নিয়ে আগের মতো সেই সমস্যা নেই। একটি মাত্র 'ক্লিক' বা 'টাচ'-এ ইন্টারনেটের সাহায্যে মুহূর্তে লেখা প্রকাশ করা যায় ব্লগ, ওয়েব ম্যাগাজিন, সোশ্যাল মিডিয়া, নিউজ পোর্টাল ইত্যাদি নানা জায়গায়। আর এইসব জায়গায় প্রকাশে কেবলমাত্র নেট সংযোগ ও কমপিউটার বা স্মার্ট ফোনে লিখতে জানলেই হ'ল। প্রকাশিত লেখা অতি দ্রুত নেট-বাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। প্রকাশককে পান্ডুলিপি পাঠানো, প্রুফ দেখা, মুদ্রণ, দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা, বাঁধাই, আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ইত্যাদির ঝক্কি নেই। পরিবেশ রক্ষায় গাছ কেটে কাগজ তৈরীর সমস্যাও নেই। দিন যত যাচ্ছে বিকল্প মাধ্যম হিসেবে তত এই জাতীয় মাধ্যম নিজেদের গুরুত্ব বোঝাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি না, অন্তত আমাদের কাছে বইয়ের বিকল্প আজও আসে নি। বই মানেই এক সাবেক নস্টালজিয়া- বিখ্যাত কবি-লেখকদের সঙ্গে একাত্মতাবোধ। বইপ্রকাশ মানেই যেন এক ধাক্কায় সাহিত্যসমাজে 'এলিট' হয়ে যাওয়া। তাই বাঙালি কবি বা লেখক মাত্র এখনও বই ছাড়া ভাবতে পারেন না। অধিকাংশ কবি-লেখকরাই মনে করেন যে, বইয়ের বিকল্প নেই। লেখা প্রকাশের প্রথমদিন থেকেই তাঁরা তাই স্বপ্ন দেখেন নিজের লেখা একটি বইপ্রকাশের।

আর ঠিক এই জায়গাটিতে আসেন প্রকাশকেরা। যত দিন যাচ্ছে, প্রকাশনা ব্যবসাতেও তত নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। অতীতের প্রকাশনার সঙ্গে আজকের প্রকাশনার আকাশপাতাল তফাত। একটি একটি করে অক্ষর সাজিয়ে ব্লক প্রিন্টের দিন আর নেই। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসে গেছে কমপিউটার প্রিন্ট। ডিজিটাল বলে তা যথেষ্ট সুদৃশ্য। একইভাবে প্রচ্ছদও হচ্ছে নজরকাড়া। একটি প্রকাশিত বই হাতে নিয়ে পাঠকের মুগ্ধতা আসতে বাধ্য। দুরন্ত বিন্যাস, অলঙ্করণ ও সজ্জার সেই বই যে কোনও কবি বা লেখকের স্বপ্ন। অনেকটা সেই আপ্তবাক্যের মতো 'পহলে দর্শনধারী, বাদ মে গুণবিচারী'।

আপাতত গুণবিচার সরিয়ে রেখে বলি যে, প্রকাশনা আজ আদ্যন্ত ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তবে কি অতীতে ব্যবসা ছিল না? ছিল। কিন্তু ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশনার সুনাম বজায় রাখবার জন্য প্রকাশকদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকত।সেজন্যই সব লেখার ছাড়পত্র চটজলদি মিলত না। বাছাই লেখাই সুযোগ পেত বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার। সেসব প্রকাশনা সংস্থার ধার ও ভার এতটাই ছিল যে, সকলে লেখা পাঠাবার সাহসও পেত না। ফলে পাঠকের হাতে যে বই আসত তা সত্যিই সুসাহিত্যের নিদর্শন হয়ে রইত। অনেক বই কালজয়ী হত। প্রকাশকেরা নিজেরা সকলে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল না হলেও সাহিত্য ব্যাপারটা ভাল বুঝতেন। লেখা পড়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন কোন কবি-লেখকের লেখা সাহিত্যে স্থান নিতে পারে। সেই জাতীয় প্রকাশক আজ নেই তা কিন্তু নয়। তবে তাদের সংখ্যা আজ অত্যন্ত কম। আর এখন তো অধিকাংশ প্রকাশক বই প্রকাশ করবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কেননা কতিপয় প্রকাশক বাদে বেশির ভাগ প্রকাশকই টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করে থাকেন। এদের কাছে সাহিত্য উপলক্ষ, মূল উদ্দেশ্য হল ব্যবসা আর তার জন্য তারা সর্বদা হাজির। নবীন কবি-লেখকরা তাদের আমদানির উপায় মাত্র, আর সেই আমদানি করতে গিয়ে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে কোনও অসুবিধে নেই।
 
কিন্তু বই প্রকাশ করতে গিয়ে একজন তরুণ কবি বা লেখকের স্বপ্নপূরণ হচ্ছে কি? বোধহয় নয়। এক কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অত্যন্ত রদ্দি বাঁধাই, মুদ্রণে অগুন্তি ভুল, জঘন্য কাগজ। তরুণ ছেলেটিকে যতই স্তোকবাক্য শোনাই না কেন, নিজেই বুঝতে পারছিলাম যে প্রকাশক ব্যবসাটি ঠিক করেছেন। কিন্তু আর কিছু করেন নি। একজন প্রকাশক ঠিক কতগুলি বই ছাপছেন, কতগুলি বই বিক্রি করছেন সে হিসেবও কিন্তু স্বচ্ছ নয়। লেখক কতগুলি কপি সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পাবেন সেটা অনেকসময় বোঝা যায় না যদি না চুক্তিপত্রটি সঠিক হয়। অনেক প্রকাশক আবার চুক্তিপত্রও করেন না। প্রকাশকের মুখের কথায় বিশ্বাস ক'রে ঠকে গেছেন এরকম কবি- লেখকের সংখ্যাও কম নয়।

উল্টোদিকে, অনেক কবি-লেখকও কম যান না, ক্রমাগত নানাভাবে বিব্রত করেন প্রকাশকদের। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পাতা ছাপা হয়ে যাওয়ার পরেও নতুন করে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে বাধ্য করেন। এতে যে প্রকাশকের  সমস্যা হতে পারে সেটা বুঝেও বোঝেন না। এবাদেও প্রকাশককে  বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধরণের বায়নাক্কা সামলাতে হয়।

আসলে কোনো একদিকে সকলেই সঠিক আর উল্টোদিকে সকলেই বেঠিক এটা হতে পারে না। সকলে ভাল-মন্দ মিশিয়েই তৈরী। তাই   একতরফা কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রকাশক বই ছাপবেন, লাভ করবেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি তার দিক থেকে কোনরকম চালিয়াতি পাওয়া যাবে না সেটাও প্রত্যাশিত। একজন লেখক তার প্রকাশিত হতে চলা বইয়ের জন্য যেমন প্রকাশককে বিভিন্ন বায়নায় উত্যক্ত করবেন না, তেমনি বই প্রকাশের পর বই প্রমোশনের ক্ষেত্রে তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন এটাও আশা করা যায়।

বিশ্বায়নের এই যুগে একদিকে যেমন নতুন ধরণের কর্মসংস্থান বাড়ছে, তেমনি পুরোনো দিনের অনেক কিছু হয় বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়। বই পড়বার অভ্যেসও কমে যাচ্ছে দিনদিন। সাহিত্য বা কবি-লেখকদের ঘিরে অতীতের সেই উন্মাদনাও নেই। তবু নিত্যদিন নিত্যনতুন বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। লেখকদের বই প্রকাশের তীব্র ইচ্ছা ও সেই বইকে প্রকাশের দায়িত্ব নেওয়া প্রকাশক...এভাবেই চলছে আজও, হয়তো চলবেও আরও বহুদিন। একে অপরের পরিপূরক হওয়ায় এই সম্পর্ক সর্বদাই টক-ঝাল-মিষ্টি। তাই আশা করা যেতে পারে যে, দু'জনেই দু'জনের মান রাখবেন পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রেখে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চা-পাতা ১০০

চা-পাতা ৯১