১৩.
অনিমেষ একটা সিগারেট থেকে আর একটি সিগারেটে চলে যেতে যেতে একটা নুতন লেখা শুরুর কথা ভাবে। বেসিকালী সে ভেতরে ভেতরে একটা লেখাই লিখছিল।সিগারেটের না ফুরোন অংশ অনিমেষ ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর ফুলস্কেপ কাগজে লেখা শুরু করে দেয়।
১৪.
অনিমেষ লিখতে থাকে_
‘তখন জেগে উঠতে থাকে গিয়াসুদ্দিনের পৃথিবী।পাছা আইতের মোরগ ডাকে ইমামসাহেবের বাড়ির খোলানে।সারারাত মাছ ধরে ডিঙি ঘাটায় রেখে জাল গুটিয়ে মাছ ভরা খলাই নিয়ে বাড়ির পথ ধরে গিয়াসুদ্দিন। শরীরেপানিকাদার আঁশটে গন্ধ।সালাইবিড়ি স্যাঁতসেঁতে।বহুবারের চেষ্টায় বিড়ি ধরায় গিয়াসুদ্দিন।আজ মনটা বেশ খুশীয়াল। বহুদিন পর প্রচুর মাছ পেয়েছে সে। সবই পীরফকিরের দোয়া। গান ধরে গিয়াসুদ্দিন-
‘হাউসের মেলা জোড়া খেলা/ধল্লা নদীর কাছাড়ে/ও রে /গুয়াচাচার নাও ফাইনালে...’
গিয়াসুদ্দিন,পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই ;মেদহীন কিন্তু শক্ত চেহারা।ইয়াকুব মাঝির মাইঝা বেটা ।বংশপরম্পরায় মাঝিবংশ।বাপইয়াকুব ,বাপের বাপ আনসারুদ্দিন ;যাদেরদাপ ও তাপ ছিলো যথেষ্টই। সে অবশ্য ইন্ডিয়া পাকিস্থান হবার অনেক আগের কথা। বাড়ির দুয়ারে এসে গিয়াসুদ্দিন দ্যাখে শামিমা দাঁড়িয়ে আছে। ঝরিমন চুলায় খড়ি গুঁজছে। মনে আনন্দহল তার। সত্যি বিবি হিষাবে শামিমার জুড়ি মেলা ভার।বেটি ঝরিমনও হয়েছে আম্মুর মত।শামিমা মাছের খলাই নিল গিয়াসুদ্দিনের হাত থেকে।ঝরিমন ও ছোট বিটি আফসানা দৌড়ে এল ‘বাপজান বাপজান’ বলতে বলতে।আহা,
এই না হলে সুখ!সোনার সংসার!শরীরভরা পুলক নিয়ে গিয়াসুদিন তার পৃথিবীতে ঢুকে গেল।আকাশে আলো ফুটেছে তখন।চারপাশে পাখপাখালি,ধানখেতে হলখল বাতাস।বেলা গেইছে ভাটিট। আওলিয়ার হাট থেকে বুড়িমারি যাচ্ছে সাইকেল চালিয়ে মোহাম্মদ খোরশেদআলম।সবাই চেনে খোরশেদ ভাই নামে।লালমণি পরিবহনের বুড়িমারি কাউন্টারের ম্যানেজার।এছাড়া সীমান্তের টুরিস্টদের কাজকর্মও করতে হয় খোরশেদকে।ইণ্ডিয়ার এক ভাইজান আছে যিনি লেখালেখি করেন,তার কাজও করতে হয়। এই যেমন,ইণ্ডিয়ার ভাইজানের এক বাংলাদেশী কবিবন্ধু খালিদ ভাই আজ এসেছিল বুড়িমারি সীমান্তে।খালিদভাই-কে সঙ্গ দিতে হল। এরপর ট্রেনধরিয়েও দিতে হল।খালিদভাইয়ের বাড়ি লালমণিরহাটের আদীতমারীতে।এখন পড়াশোনা করছে রংপুরে।খোরশেদ ভাই ভীষণ ব্যাস্ততায় আছে এখন।কাউণ্টারে ভিড় বাড়ছে,কেননা সামনে ইদ। বেশ চাপ। অনেক রাত হয় আজকাল বাড়ি ফিরতে।আর সীমান্তে বি এস এফ-এর বেশ নজরদারী।ভয় লাগে রাতবিরেতে একা একা যাতায়াত করতে।ধরলা নদীর ব্রিজে ওঠার মুখেই রেজ্জাক ও পুলিশভাই-এর সঙ্গে দেখা।ওরা
বললো-‘ভাইজান,চল
বাহে;আজি আইতত বাউরা বাজারত পালা দেখির যাই। ময়নামতির নাচ দেখি আসি চল কেনে, হামরা অংপুরিয়া মানষি। রঙ্গ-রসত বাঁচি থাকি’।খোরশেদ রাজি হল।মনে মনে ভাবল-‘বিবিজানক ফোন করি এল্যা কওয়া খায়,আইতত যেন মোর বাদে ভাত না রান্ধে; মাছ না ভাজে।বিহানতে আসিয়া কাউণ্টারত খোয়া
খায়।‘এইসব ভাবতে ভাবতে বুড়িমারি চলে এল।আজি বুড়িমারিত হাট।মেলা মানসি।দোতরা ডাঙেয়াকবিরাজ আইচ্চে দেখং মেলা দিন পাছত! খোরশেদ লালমণি পরিবহনের অফিসে ঢুকতেই ইণ্ডিয়ার চ্যাংরাবান্ধা বর্ডারের কাউণ্টারের বিভাস সাহা,মানে বিভাস ভাইজানের ফোন এল।
গিয়াসুদ্দিন থাকে গিয়াসুদ্দিনের পৃথিবীতে।খোরশেদ আলম থাকে তার ভূবনেই।গান নাচ হাউড় বাউড় আবারকূপির আলোয় বাজারহাটের দেশকালের রঙ্গরস ভরা এক জীবন খেলা করে যায়।ধরলা নদী দিয়ে গ্যালন গ্যালনপানি। গামছাবান্ধা দই। দোতরা বাজিয়ে গান ধরে খইমুদ্দি পাগেলা।পুলিশ রেজ্জাক আব্দুল সিরাজেরা হাততালি দিয়ে ওঠে।কোথাও শ্যাখের বেটির জনসভা হয়।বাদ্য বাজে।বেগমসাহেবার পদযাত্রায় মাতম ওঠে।কোনো কোনো
হাটে ছিলকা ঘোরে-‘বান পানি বরসা/পল্লিবন্ধু ভরসা’...’নীলসায়রের বিলে বাইচের নাও ভাসে।
দেশকালঅতীতবর্তমানবাহিত হয়ে ধরাছোঁয়ার খেলার মত দিনকালের ধাঁধাবৃত্তে নতুনতর হয়ে ওঠে।
খোরশেদ আলম চা খেতে যায় ফিরোজ-এর মরিচহাটির দোকানে।গিয়াসুদ্দিন ঢাকার বাসে চেপে বসে বউবিটি নিয়ে।
লোকপৃথিবীর ভিতর নিশারাত্তিরের স্তব্ধতা।দূরেকাছের কুকুর শেয়ালেরা সুর মেলায় রাতচরাপাখিদের গানে।বোধাবোধির সকল সীমাপরিসীমা একাকার করে দিয়ে মানুষ তার বেঁচে থাকাটাকে আদ্যন্ত এক চিরকালীনতার দর্শনের সাথে কেমন যেন মিলিয়েই ফেলতে থাকে! হারিয়েই ফেলতে থাকে কুয়াশাশিশিরস্নাতগাথা শোলকের অতিজীবিত ট্রমার চলাচলজাত রাস্তাগুলিতে হেঁটে যাবার অতিআবশ্যক বাধ্যবাধকতায়’।
একটানা লিখবার পর অনিমেষ আবার একটা সিগারেট ধরায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন